
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নির্বাচন মানেই উত্তাপ, প্রতিযোগিতা, এবং মাঝে মাঝে সহিংসতার ছায়া। সেই ছায়া এবার নেমেছে চট্টগ্রাম-৮ আসনে। বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ও চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহর নির্বাচনী জনসংযোগ পরিণত হয়েছে রক্তাক্ত ঘটনায়। সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলিতে নিহত হয়েছেন মোহাম্মদ সরওয়ার হোসেন বাবলা, গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এরশাদ উল্লাহসহ চারজন।
বুধবার সন্ধ্যায় বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন চালিতাতালী পূর্ব মসজিদ এলাকায় এই গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে, যা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, প্রচারণা চলাকালে ভিড়ের মধ্য থেকে এক যুবক এগিয়ে এসে খুব কাছ থেকে সরওয়ারের ঘাড়ে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি ছোড়ে। মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক, আর বাতাসে বাজতে থাকে একের পর এক গুলির শব্দ।
হামলার টার্গেট কে? বিভ্রান্তির ঘূর্ণিতে তদন্ত
নিহত সরওয়ার হোসেন বাবলা পুলিশের তালিকাভুক্ত এক শীর্ষ সন্ত্রাসী ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় অন্তত ১৮টি মামলা রয়েছে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে তিনি নিজেকে বিএনপির কর্মী হিসেবে পরিচয় দিতেন, দলটি তাঁর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক অস্বীকার করেছে।
পুলিশের ধারণা, বাবলা ও তার প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদের মধ্যে আধিপত্যের দ্বন্দ্ব থেকেই গুলির সূত্রপাত। তবে হামলার সময় পাশে থাকায় গুলিবিদ্ধ হন প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ ও তাঁর সঙ্গীরা।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হাসিব আজিজ জানান, আমাদের ধারণা, এরশাদ উল্লাহ মূল টার্গেট ছিলেন না। টার্গেট ছিলেন সরওয়ার বাবলা। যারা হামলা করেছে, তারা বাবলার প্রতিপক্ষ।”
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া: অভিযোগ, নিন্দা ও পাল্টা বিবৃতি
ঘটনার পরপরই শুরু হয় দোষারোপের রাজনীতি। বিএনপি নেতা-কর্মীরা সরাসরি জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করে বলেন, এটি এক পরিকল্পিত রাজনৈতিক হামলা”। তবে জামায়াত এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে, বরং দাবি করে — এটি দুটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের ফল।”
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে বলেন,
নির্বাচন বানচাল ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির ষড়যন্ত্রেই এই হামলা চালানো হয়েছে।”
অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানায়। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিরাপত্তা বাহিনীকে দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় আনতে নির্দেশ দিয়েছেন। সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ুএরশাদ উল্লাহ মূল টার্গেট ছিলেন না; বিক্ষিপ্তভাবে ছোড়া একটি গুলিই তাঁকে আহত করেছে।”
নির্বাচনের আগে উত্তেজনা বাড়ছে
এই হামলার পর চট্টগ্রাম মহানগরজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়েছে। বিএনপির নেতারা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন নাসিমন ভবন পর্যন্ত। তাদের দাবি—ুধানের শীষের প্রার্থীকে লক্ষ্য করে উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর হামলা হয়েছে।”
এদিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, ুতদন্তে রাজনৈতিক নয়, অপরাধী চক্রের দ্বন্দ্বের দিকটি প্রাধান্য পাচ্ছে।” তবে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই মাঠে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা বাড়ছে।
সন্ত্রাস, রাজনীতি ও জনগণের আস্থা
চট্টগ্রাম-৮ এর এই ঘটনা আবারও স্মরণ করিয়ে দিল, রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মাঠে এখনো রয়ে গেছে সহিংসতার ভয়। নির্বাচনী প্রচারণার সময় প্রার্থী ও কর্মীরা যদি নিরাপদ না থাকেন, তবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই।
মনোবিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের সহিংসতা শুধুমাত্র দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, বরং ক্ষমতার সংস্কৃতির বিকৃত রূপ। জনগণ এখন চায় নিরাপদ রাজনীতি, যেখানে ভোট হবে উৎসবের মতো, নয় আতঙ্কের মতো।
চট্টগ্রামের এই গুলির ঘটনা নির্বাচনের আগে একটি ভয়াবহ সংকেত। হত্যার দায় যেই নিক না কেন, রাজনীতির রক্তাক্ত মঞ্চে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয় গণতন্ত্রেরই। এখন দেশ তাকিয়ে আছে—দোষীরা ধরা পড়বে, নাকি এই রক্তের দাগও হারিয়ে যাবে নির্বাচনী উত্তাপে?