
সাগর মিয়া, রংপুরঃ
উত্তরাঞ্চলের প্রধান নগরী রংপুরকে প্রায় তিন দশক আগে ভূমিকম্পের রেড জোন হিসেবে ঘোষণা করা হলেও এখনো কার্যকর কোনো নিরাপত্তামূলক উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
বরং অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ, অনুমোদনহীন বহুতল ভবন, দুর্বল অবকাঠামো ও মাটির ধারণক্ষমতা কমে যাওয়া—সব মিলিয়ে এ অঞ্চল এখন আগের চেয়ে আরও বেশি ঝুঁকির মুখে।
গত ১৬ বছরে রংপুরে বড়–ছোট ১৮৫টি ভূমিকম্প রেকর্ড হয়েছে, যা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অস্বাভাবিকভাবে বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূ-অবস্থার বর্তমান পরিবর্তন ইঙ্গিত দিচ্ছে—রংপুরে যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। রংপুরবাসী নানা সময় বড় কম্পনের আতঙ্কে পড়েছেন।
২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল উৎসস্থলে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্পের ফলে প্রায় ২৫–৩০ সেকেন্ড দুলেছিল পুরো নগরী। মানুষ ঘরবাড়ি, অফিস–আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে। এর আগে একই বছরের ৫ জানুয়ারি ভোরেও ৬.৭ মাত্রার দুই দফা ভূমিকম্প কাঁপিয়ে দিয়েছিল অঞ্চলটিকে।
২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ৬.৮ মাত্রার কম্পন স্থায়ী হয়েছিল সোয়া মিনিট—যার ভয়াবহতা এখনো অনেকের মনে দাগ কেটে আছে। সর্বশেষ ২১ নভেম্বর ২০২৫ নরসিংদীর ঘোরাশালে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্প রংপুরেও স্পষ্টভাবে অনুভূত হয়, যা বিশেষজ্ঞদের মতে উত্তরাঞ্চলের জন্য সতর্ক সংকেত।
আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৫ সালের ২১ নভেম্বর পর্যন্ত রংপুরে ১৮৫ বার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। শুধু ২০২০ সালেই রেকর্ড হয়েছে ভয়াবহ ৭৪ বার কম্পন—এর মধ্যে ৩–৪ মাত্রা ৩৫ বার, ৪–৫ মাত্রা ৩৩ বার এবং ৫–৬ মাত্রা ৬ বার।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান মোস্তাফিজুর রহমান জানান, রংপুর অবস্থান করছে দুই ভয়ঙ্কর সক্রিয় ফল্ট—মধুপুর ফল্ট ও শিলং ফল্টের মাঝখানে। এ দুটি ফল্টের মধ্যবর্তী এলাকাগুলোতে ভূকম্পনের চাপ সবচেয়ে বেশি।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশকে তিনটি ভূমিকম্প জোনে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সিলেট, আর তার পরেই রংপুর।” গবেষণায় পাওয়া গেছে, গত ১৫ বছরে রংপুর অঞ্চলে জলস্তর ২০–৩০ ফুট পর্যন্ত নেমে গেছে, ফলে মাটির ভর কমে শূন্য-বহুল ও আলগা হয়ে পড়েছে, যা ভূমিকম্পে সহজেই ধসে যেতে পারে। ইতিহাস বলছে, ১৮ শতকের শেষ দিকে চিলমারী অঞ্চলে ৮.৫ মাত্রার ভয়াবহ ভূকম্পন হয়েছিল; গবেষকরা মনে করেন, এত বড় কম্পন আবারও ঘটতে পারে। রেড জোন ঘোষণার প্রায় ২৯ বছর পরেও রংপুরে ভূমিকম্প প্রস্তুতি ও নিরাপত্তা কোনোটিই কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।
শহরজুড়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবে গড়ে উঠেছে অনুমোদনহীন বহুতল ভবন; মডার্ন মোড়, শাপলা চত্বর, ধাপ, মেডিকেল রোড, সেনপাড়া ও জুম্মাপাড়ায় ভবনের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। ২০১৬ সালের সিটি করপোরেশনের জরিপে নগরীর ৪৭টি সরকারি স্থাপনাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়—এর মধ্যে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পুলিশ সুপার কার্যালয়, পুরাতন সার্কিট হাউস, ট্রেজারি ভবনসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর রয়েছে।
অস্থায়ী সংস্কার ছাড়া এসব ভবনে এখনো প্রতিদিন মানুষের চলাচল ও কার্যক্রম চলছে। ২০২০ সালে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে রংপুর সেনানিবাসে কয়েকটি দপ্তর নিয়ে তিন দিনের বৈঠকে ভূমিকম্প মোকাবিলার পরিকল্পনা তৈরি হলেও তা বাস্তবায়নের কোনো অগ্রগতি নেই। বড় ধরনের দুর্যোগে উদ্ধার কাজের জন্য প্রয়োজনীয় হেভি ক্রেন, কাটিং মেশিন, প্রেশার লিফটিং যন্ত্রসহ আধুনিক সরঞ্জামের ঘাটতি রয়েছে ফায়ার সার্ভিসে। রংপুর ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) বাদশা মাসুদ আলম বলেন, “ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী রংপুর অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
যদি ৬ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হয়, প্রাণহানির আশঙ্কা মারাত্মক। উদ্ধার কাজে যেসব সরঞ্জাম দরকার তার প্রায় সবসময়ই সংকট থাকে। আমরা নিয়মিত মহড়া করি, তবে এটি বড় বিপদ ঠেকানোর জন্য কখনোই যথেষ্ট নয়।” বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ বলছে, বড় ভূমিকম্প হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ঘনবসতিপূর্ণ কেন্দ্রীয় নগর এলাকা—স্টেশন রোড, জাহাজ কোম্পানি মোড়, শাপলা চত্বর, বড়বাড়ী, লালবাগ, ধাপ।
পাশাপাশি অনুমোদনহীন বহুতল ভবনসমৃদ্ধ মেডিকেল রোড, সেনপাড়া, জুম্মাপাড়া ও মডার্ন মোড়–সংলগ্ন এলাকা। এছাড়া পুরাতন সরকারি কাঠামো—COB এলাকা, পুরাতন হাসপাতাল ভবন, আবাসিক এলাকা ও পুরাতন সরকারি দপ্তরগুলোও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। রংপুরবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি—বিল্ডিং কোড যথাযথভাবে বাস্তবায়ন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে সরকারি কার্যক্রম বন্ধ, ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ল্যাব স্থাপন, ফায়ার সার্ভিসের আধুনিকীকরণ, নগরজুড়ে জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, নিয়মিত মক ড্রিল এবং স্কুল–কলেজে ভূমিকম্প সচেতনতা প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা।
কিন্তু কোনো উদ্যোগই বাস্তবে রূপ পায়নি।
রেড জোন হিসেবে রংপুরের ঝুঁকি অনেক দিনের, কিন্তু প্রস্তুতির অভাব মারাত্মক। নগরজুড়ে অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ, দুর্বল অবকাঠামো, সংকীর্ণ রাস্তা, পুরাতন ভবনের ভঙ্গুরতা—সব মিলিয়ে একটি বড় ভূমিকম্প হলে রংপুরে প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা ভয়াবহ হবে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন। তাঁদের মতে, “সময়সীমা খুব কম।
এখনই প্রস্তুতি শুরু না করলে রংপুরকে ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মূল্য দিতে হবে।”