
বরেন্দ্রকন্ঠ ডেস্কঃ
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘গণভোট’ শব্দটি যতটা প্রভাবশালী, ততটাই বিতর্কিত। গণতন্ত্রে জনগণের মতামতই সর্বোচ্চ- এই দর্শন থেকেই গণভোটের ধারণার জন্ম। কিন্তু বাস্তবে এই প্রক্রিয়া কতটা জনগণের মতের প্রতিফলন আর কতটা রাজনৈতিক শক্তির কৌশল, সেটি নিয়েই চলছে দীর্ঘ বিতর্ক। আজ যখন রাজনীতিতে জনমতের প্রতিফলন ও জনগণের অংশগ্রহণ নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে, তখন গণভোটের প্রশ্নটি আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
গণভোট (Referendum) হলো এমন এক ভোট ব্যবস্থা, যেখানে সরাসরি জনগণকে কোনো নির্দিষ্ট প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’-এর মাধ্যমে মত দিতে বলা হয়। এটি সাধারণ নির্বাচনের মতো নয়- এখানে মানুষ ব্যক্তি বা দল নয়, বরং কোনো নীতি, আইন, বা সংবিধান সংশোধন বিষয়ে মত প্রকাশ করে। সহজভাবে বললে, গণভোট মানে হলো ‘জনগণের সরাসরি সিদ্ধান্ত’।
বিশ্বে গণভোটের ইতিহাস বেশ পুরনো। প্রাচীন গ্রিসে নাগরিকদের সরাসরি মতামত নেওয়ার প্রচলন ছিল। আধুনিক যুগে সুইজারল্যান্ড এই পদ্ধতিকে নিয়মিত রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। ব্রিটেনের ব্রেক্সিট গণভোট কিংবা স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা প্রশ্নে গণভোট বিশ্ব রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
বাংলাদেশের সংবিধানে গণভোটের অবস্থান
১৯৭২ সালের সংবিধানে গণভোটের একটি বিশেষ উল্লেখ রয়েছে। মূলত সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সংবিধানের কিছু মৌলিক অংশ পরিবর্তনের প্রস্তাব সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন পেলেও, তা কার্যকর হওয়ার আগে গণভোটে জনগণের অনুমোদন নিতে হবে।
এই ধারা থেকেই বোঝা যায়- গণভোটকে বাংলাদেশের সংবিধান জনমতের চূড়ান্ত প্রতিফলন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত মাত্র একবারই দেশে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৯৭৭ সালে, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়।
১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। ১৯৭৭ সালের ৩০ মে তিনি গণভোটের আয়োজন করেন। প্রশ্ন ছিল “আপনি কি রাষ্ট্রপতি মেজর জিয়াউর রহমানের ঘোষিত নীতি ও কর্মসূচিকে সমর্থন করেন?”
সরকারি হিসেবে ভোটে অংশ নেয় প্রায় ৮৮ শতাংশ ভোটার, যার মধ্যে ৯৯ শতাংশই ‘হ্যাঁ’ ভোট দেয়। ফলাফল প্রকাশের পর রাষ্ট্রপতি জিয়া বলেন, “জনগণ তার ওপর আস্থা রেখেছে।” কিন্তু বিরোধী পক্ষ বলেছিল- এটি ছিল এক ধরনের ‘ভোট নাটক’। ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, ভীতি ও প্রশাসনিক প্রভাবের অভিযোগও ওঠে।
যাই হোক, এই গণভোটের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জনগণের মতামত নেওয়ার একটি প্রতীকী প্রয়াস দেখা গিয়েছিল।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত গণভোট আয়োজনের স্পষ্ট আইন বা প্রক্রিয়াগত কাঠামো গড়ে ওঠেনি। নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে এটি অনুষ্ঠিত হতে পারে কিন্তু কিভাবে প্রশ্ন নির্ধারণ হবে, ভোটার তালিকা কীভাবে প্রযোজ্য হবে, গণমাধ্যম কী ভূমিকা রাখবে, এসব বিষয়ে নির্দিষ্ট বিধান অনুপস্থিত।
বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে গণভোট সম্পর্কে সচেতনতা তুলনামূলক কম। অনেকেই মনে করেন, এটি রাজনীতিবিদদের বিষয়, তাদের মতামত নেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। তবে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে কৌতূহল বাড়ছে।
আজ বাংলাদেশে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু- যেমন রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা, সংবিধান সংশোধন, বা বড় কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি নিয়ে গণভোট আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়। তাহলে এর ফলাফল কী হতে পারে?
প্রথমত, এটি জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়াবে। দ্বিতীয়ত, এটি সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে একটি ঐক্যমতের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। তবে এর বিপরীতে আশঙ্কাও কম নয়। প্রশাসনিক প্রভাব, ভোট কারচুপি, সামাজিক বিভাজন ও ধর্মীয় আবেগের ব্যবহার গণভোটকে বিভ্রান্তিকর রূপ দিতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, “বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে রাজনৈতিক সংস্কৃতি দলীয় প্রভাবাধীন, সেখানে গণভোট আয়োজনের আগে প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা দরকার। নইলে এটি আবারও রাজনৈতিক অস্ত্র হয়ে উঠবে।” অন্যদিকে, “গণভোট নাগরিকদের ক্ষমতায়নের একটি সুযোগ। তবে এটি নিয়মিত ও স্বচ্ছভাবে না হলে জনগণের আস্থা নষ্ট হতে পারে।”
আন্তর্জাতিক ভাবে দেখলে শেখার আছে অনেক কিছু
সুইজারল্যান্ডে বছরে একাধিক গণভোট হয়। প্রতিটি ইস্যুতে জনগণের মতামত নেওয়া হয়। ব্রিটেনের ‘ব্রেক্সিট’ গণভোটে দেখা গেছে, একটি ভোট কীভাবে পুরো দেশের ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা সময়সাপেক্ষ হলেও অসম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, ও শিক্ষিত নাগরিক সমাজ।
গণভোটের আগে ও পরে গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণ যেন সঠিক তথ্য পায়, মতামত গঠন করতে পারে, সেটি নিশ্চিত করতে সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব অপরিসীম।
কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় গণমাধ্যম অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাবের মধ্যে পড়ে যায়। এজন্য গণভোটকে কেন্দ্র করে স্বাধীন সাংবাদিকতা নিশ্চিত করা জরুরি।
বাংলাদেশে যখন গণতন্ত্রের পথচলা নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে এগোচ্ছে, তখন গণভোটের ধারণা নতুন করে আলোচনায় এসেছে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, জনগণের মতামত সরাসরি জানার এই পদ্ধতিটি পুনরুজ্জীবিত করা গেলে গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হবে।
তবে এর জন্য প্রয়োজন- রাজনৈতিক ঐক্যমত, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা
সচেতন নাগরিক অংশগ্রহণ। এই চারটি উপাদান ছাড়া গণভোট আবারও হবে কেবল একটি “রাজনৈতিক নাটক”।
গণভোট একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক হাতিয়ার। যদি সেটি সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়। এটি জনগণকে ক্ষমতায়িত করে, রাজনীতিকে জবাবদিহিমূলক করে তোলে। কিন্তু অপব্যবহার হলে গণভোট পরিণত হয় ‘জনমতের নামে রাজনৈতিক অনুমোদনের প্রহসনে’।
বাংলাদেশের ইতিহাসে মাত্র একবার গণভোট হয়েছে, কিন্তু জনগণের মতের সেই প্রতিধ্বনি আজও বিতর্কিত। তবুও আশার কথা- যদি কখনো দেশের ভবিষ্যৎ দিক নির্ধারণে জনগণকে সরাসরি সিদ্ধান্ত দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়, সেটিই হবে প্রকৃত গণতন্ত্রের বিজয়।