
আরিফুল ইসলাম রনক
সময়টা ছিল একেবারে আলাদা। একসময় চিঠিই ছিল মানুষের যোগাযোগের একমাত্র ভরসা। শহর থেকে গ্রাম, দেশ থেকে বিদেশ—সবখানেই সম্পর্কের সেতুবন্ধন তৈরি করত সেই চিঠির পাতায় লেখা কিছু শব্দ। ডাকবাক্সে ফেলা একটি খামে কত গল্প, কত অপেক্ষা, কত ভালোবাসা জমে থাকত! কিন্তু আজ সেই চিঠি যেন হারিয়ে গেছে স্মৃতির পাতায়।
আজ ৯ অক্টোবর, বিশ্ব ডাক দিবস। ১৮৭৪ সালের এই দিনে সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়ন (UPU)। পরে ১৯৬৯ সালে টোকিও কংগ্রেসে এই দিনটিকে “বিশ্ব ডাক দিবস” হিসেবে ঘোষণা করা হয়। দিনটি প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে উদযাপিত হয় ডাকসেবা ও ডাককর্মীদের অবদান স্মরণে।
বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে ডাকবিভাগের ইতিহাস প্রায় দেড় শতাব্দী পুরোনো। একসময় সকাল-বিকেল চিঠি পৌঁছে যেত ডাকপিয়নের হাত ধরে। কাঁধে ব্যাগ, মাথায় খাকি টুপি—এই দৃশ্য ছিল গ্রামবাংলার এক অমোঘ প্রতিচ্ছবি। প্রেমের চিঠি, পরীক্ষার ফলের খবর, বিদেশে থাকা ছেলের পাঠানো টাকার সংবাদ—সবই আসত সেই চিঠির খামে ভরে।
চিঠি মানেই ছিল প্রতীক্ষা। দিন গুনে থাকা, ডাকপিয়নের ঘণ্টার শব্দ শুনে দৌড়ে যাওয়া। খামের কাগজে স্পর্শ থাকত প্রিয়জনের হাতের উষ্ণতা, আর শব্দে থাকত হৃদয়ের গভীর টান। তখন যোগাযোগ ছিল ধীর, কিন্তু সম্পর্ক ছিল গভীর ও আন্তরিক।
তারপর এল মোবাইল ফোন, ই-মেইল, সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ। যোগাযোগ হয়ে গেল মুহূর্তের ব্যাপার। ভালোবাসা, খবর, দুঃখ—সব এখন এক ক্লিকের দূরত্বে। চিঠির জন্য আর অপেক্ষা করতে হয় না, ডাকবাক্সে খাম জমে না, ডাকপিয়নের মুখ আর দেখা যায় না।
প্রযুক্তির এই দৌড়ে চিঠি যেন হারিয়ে ফেলেছে তার অস্তিত্ব। ডাক বিভাগ এখন কুরিয়ার ও পার্সেল সার্ভিসের ওপর নির্ভরশীল। হাতে লেখা চিঠি পাওয়া এখন একপ্রকার নস্টালজিয়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ারা ইসলাম বলেন,
“চিঠি শুধু যোগাযোগের মাধ্যম ছিল না, এটা ছিল একধরনের সাহিত্য। প্রতিটি চিঠির মধ্যে ছিল মানুষের মনের ভাষা, সময়ের ইতিহাস। এখন যোগাযোগ বেড়েছে, কিন্তু আবেগটা হারিয়ে গেছে।”
প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ ডাক বিভাগও বদলে গেছে। এখন ডাকঘরে টাকা পাঠানো, ই-কমার্স পণ্য ডেলিভারি, অনলাইন বিল পরিশোধ, এমনকি মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ’-এর মতো আধুনিক সেবা যুক্ত হয়েছে।
ডাক অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে প্রায় ৯,৮৮৬টি পোস্ট অফিস সক্রিয় রয়েছে। প্রতিদিন ডাক বিভাগ ই-কমার্স পণ্য ডেলিভারিতে ব্যস্ত থাকে, বিশেষত গ্রামীণ অঞ্চলে। ফলে ডাক বিভাগ এখন শুধু চিঠি নয়, বরং ডিজিটাল অর্থনীতির অংশ।
বাংলাদেশ ডাক বিভাগের মহাপরিচালক বলেন,
“আমরা ডাক বিভাগের ঐতিহ্য ধরে রেখেই আধুনিকায়নের পথে হাঁটছি। আজকের ডাক বিভাগ শুধু চিঠি বহন করে না, বরং নাগরিক সেবা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।”
যদিও শহরে চিঠি এখন বিরল, গ্রামের কিছু এলাকায় এখনও দেখা মেলে ডাকপিয়নের। বিশেষ করে বিদেশে কর্মরতদের পরিবারের কাছে পাসপোর্ট, কাগজপত্র বা সরকারি নোটিশ পৌঁছায় ডাক বিভাগের মাধ্যমেই।
নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার ডাকপিয়ন আবদুল হাকিম বলেন,
“আগে দিনে ২০–৩০টা চিঠি নিয়ে বের হতাম। এখন চিঠি হাতে গোনা ২–৩টা, বাকি সব পার্সেল। তবু মানুষ এখনো আমাকে দেখে খুশি হয়—এইটা বড় পাওয়া।”
তবে গ্রামীণ ডাকঘরগুলোতে এখনো চিঠির গন্ধ আছে—পুরোনো খামের মধ্যে শুকনো গোলাপের পাপড়ি, হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজে আঁকা প্রিয়জনের হাতের লেখা।
আজকের তরুণরা চিঠিকে জানে মূলত গল্প, সিনেমা কিংবা সাহিত্য থেকে। কেউ কেউ শখ করে প্রেমপত্র লেখে বা পুরোনো স্টাইলের খাম ব্যবহার করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে “লেটার রাইটিং ডে” পালনের ট্রেন্ডও দেখা যায়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুমা আক্তার বলেন,
“আমি একবার আমার বন্ধুকে হাতে লেখা চিঠি পাঠিয়েছিলাম। সে এতটাই আবেগপ্রবণ হয়েছিল যে ভিডিও কলে কেঁদে ফেলেছিল। মনে হয়, হাতে লেখা চিঠির আবেগ কখনো হারায় না।”
বিশ্ব ডাক দিবসের মূল লক্ষ্য হলো—ডাকসেবা মানুষের জীবন ও সমাজে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তা তুলে ধরা। আজকের ডিজিটাল যুগেও ডাক বিভাগের প্রাসঙ্গিকতা কমে যায়নি; বরং তা নতুন রূপে ফিরে এসেছে। ই-কমার্স, লজিস্টিক, ফিনটেক—সবখানেই ডাক ব্যবস্থার অবদান রয়েছে।
প্রতি বছর বাংলাদেশে এই দিনটি পালিত হয় নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে—র্যালি, আলোচনা সভা, ডাকঘর সংস্কার উদ্যোগ, ডাকপিয়নদের সম্মাননা প্রদান ইত্যাদি।
চিঠির যুগের আবেগ শুধু যোগাযোগের নয়, এটি ছিল একপ্রকার শিল্পও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সৈয়দ মুজতবা আলীর চিঠিগুলো আজ সাহিত্য হিসেবে পঠিত হয়। তাদের চিঠির মাধ্যমে আমরা জানতে পারি এক যুগের সামাজিক, রাজনৈতিক, এমনকি পারিবারিক প্রেক্ষাপট।
আজও অনেক গবেষক মনে করেন, হাতে লেখা চিঠি সংরক্ষণ করা মানে ইতিহাস সংরক্ষণ করা। চিঠি হারিয়ে যাওয়া মানে এক প্রজন্মের অনুভূতির বিলুপ্তি।
সময় বদলেছে, মানুষ বদলেছে, যোগাযোগের মাধ্যমও বদলে গেছে। কিন্তু সেই পুরোনো চিঠির উষ্ণতা, অপেক্ষার রোমাঞ্চ আর হৃদয়ের ছোঁয়া—সেগুলো এখনো মনে পড়ে যায়।
ডাক বিভাগ তার আধুনিক রূপে এগিয়ে চলেছে, কিন্তু চিঠি আজও স্মৃতির সবচেয়ে কোমল অধ্যায় হয়ে আছে। বিশ্ব ডাক দিবসের এই দিনে হয়তো আমরা সবাই একটিবার ভাবতে পারি—কখনো প্রিয়জনকে একটা চিঠি লিখে দেখা যেতে পারে, শুধু অনুভবের জন্যই।