
শাহজাদপুর থেকে নাজমুল হকঃ
যমুনার বুক চিরে যখন নৌকা চলে, নদীর হাওয়ায় ভেসে আসে এক অদ্ভুত হাহাকার—সে হাহাকার জমির নয়, মাটির নয়; সে হাহাকার “নিজভূমি” নামে একটুকরো আশ্রয়ের।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার জগতলা, খারুয়া, মৌকুরি, ভাটপাড়া ও বারোপাখিয়া—যমুনার চরজুড়ে ছড়িয়ে আছে দুই শতাধিক ভূমিহীন নারী-পুরুষের বসতি। কেউ নদীভাঙনে হারিয়েছে ঘরবাড়ি, কেউ জন্ম থেকেই অন্যের জমিতে দিন কাটিয়ে আসছে। কিন্তু প্রত্যেকের হৃদয়ে একটাই স্বপ্ন—নিজ নামে একটুকরো জমি, যেখানে মাথা গুঁজে বাঁচা যায়, মৃত্যুর পরও কেউ বলতে পারে, “এ মাটি তার।”
আমির হোসেন সরদার বয়সের ছাপ বয়ে বেড়াচ্ছেন ষাট পার হয়ে। চোখে নদীর মতোই গভীর ক্লান্তি আর মায়া। প্রতিদিন ভোরে কাজের খোঁজে বের হন, সন্ধ্যায় ফেরেন খালি হাতে। বুকের ভেতর তার একটিই আকুলতা—“যদি নিজের নামে একটুকরো জমি থাকতো, একটা ঘর তুলতাম।” দীর্ঘশ্বাস মিশে যায় যমুনার হাওয়ায়।
কাঞ্চনী খাতুন, কদবানু, লামেল, তামবী খাতুন, লস্কর আলী, নজরুল ইসলাম, ঠান্ডু সরদার, ইউসুফ আলী, জালাল ও শহীদ সরদারের জীবনকথাও একই সুরে বাঁধা। নদী যখন গর্জে ওঠে, তাদের বুক কাঁপে—আবার না ভিটেমাটি হারাতে হয়!
কাঞ্চনী খাতুন আর তামবী খাতুন নদীর ধারে ভাঙাচোরা ঘরে বসবাস করেন। বর্ষার দিনে ছাদের ফুটো দিয়ে পানি পড়ে, তবু তারা বলেন, “আমাদের বিলাসিতা লাগে না, শুধু নিজের নামে একটুকরো মাটি চাই। নিজের মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস নিতে চাই।”
এই মানুষগুলোর কাছে ভূমি মানে সম্পত্তি নয়, মানে অস্তিত্ব। নদীভাঙনে যখন ঘরবাড়ি ভেসে যায়, তখন শুধু কাঠ-খড় নয়—ভেসে যায় শিকড়ও, সম্পর্কও। কিন্তু বুকের ভেতর এমন নীল কষ্টের মাঝেও তারা বাঁচে, হাসে—কারণ আশা নামের এক আলো এখনও নিভে যায়নি।
জগতলা আর খারুয়ার আকাশে প্রতিদিনই সূর্য ওঠে, নদীর জলে আলো খেলে যায়, আর চরজুড়ে ভেসে বেড়ায় নতুন স্বপ্নের ছায়া। হয়তো একদিন সরকার শুনবে তাদের কথা, হয়তো একদিন তাদেরও বরাদ্দ হবে একটুকরো জমি—নিজস্ব “নিজভূমি।”