
রম্য লেখক, আমিনুল হকঃ
কুড়িগ্রাম জেলার ভৃরুঙগামারী উপজেলার সীমান্তবর্তী শান্ত নদী তোষা--যার বুকে একসময় ছিল প্রানের স্পন্দন, যাতায়াতের কোলাহল আর ব্যবসা বাণিজ্যের সোনালি দিন। ওপারে ভারতের আসামের গোলকগঞ্জ থানা, এপারে বাংলাদেশের সোনাহাট স্থলবন্দর। কিন্তু আজ সেই তোষা নদী যেন সময়ের সাথে সাথে তার ভরা যৌবন হারিয়ে নীরব, স্মৃতিভারে ক্লান্ত।
একসময় তোষা ছিল দু'পারের মানুষের যোগাযোগের প্রানসেতু। নদীপথে ভেসে আসতো কাঠ, কৃষিপণ্য, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস। গমগম করতো তোষার ঘাট। গোলকগঞ্জ থেকে নৌকা পেরিয়ে মানুষ আসতো সোনাহাট বাজারে, কেউ আত্মীয়র খোঁজে কেউবা ব্যবসার কাজে। নদীর বুকে সারাদিন ভেসে বেড়াত নৌযানের সাঁই সাঁই শব্দ ।
তোষার জল ছিল গভীর। প্রবাহ ছিল শক্তিশালী। এই নদী শুধু বাণিজ্যের পথই ছিল না, ছিল দু' দেশের মানুষের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের নীরব সাক্ষী। নৌকার মাঝিদের ডাকে ঘাট জেগে উঠতো। জেলে, কৃষকেরা এই নদীকেই ভরসা করতো জীবিকার টানে। সোনাহাটের বাজার ছিল তোষার ওপর ভর করে টিকে থাকার এক প্রানচঞ্চল বানিজ্য কেনদ্র।
কালের পরিক্রমায় তোষা যেন হারাতে শুরু করলো চিরচেনা প্রাণশক্তি। ১৯৪৭ এ দেশ ভাগ, প্রাকৃতিক পরিবর্তন, সীমান্তের বিধিনিষেধ আর দিন দিন অবহেলায় নদীর বুক চিরে শুধু কচুরিপানা আর পদ্ম, শাপলার লুকোচুরি এখন। নদীর গভীরতা নেই। থমকে গেছে পানির প্রবাহ। নৌযান কবেই উঠে গেছে তোষার বুক থেকে। কোলাহলের সেই উচছাস নেই ব্যবসার ঘাটে, এখন শুধুই নীরবতা বাজে।
এখন সোনাহাট স্থলবন্দর দেশের বাণিজ্যের নতুন সম্ভবনার দিগন্ত । ট্রাকের সারি, পাথর লোডিং, আনলোডিঙ, ট্রাক ভাড়ার হাকডাক-- সব মিলিয়ে বন্দর আজ নতুন প্রজন্মের পরিচিত জায়গা। কিন্তু প্রবীনদের চোখে আজও ভাসে পুরানো তোষার রূপ। তোষার তীরের বাসিন্দা আবদুল মোতালেব বলেন, দু'দেশ মিলে নদীটিকে বাঁচালে আবারও চালু করা যেত নৌপথ। দু'দেশের মানুষের সম্পর্ক আরও সহজ হতো।
তোষা এখন অনেকটাই সরু শান্ত থিতু হয়ে থাকা এক নদী। গ্রামের প্রবীনেরা নদীর পারে দাঁড়িয়ে আজও গল্প বলেন, কেমন ছিল তোষার ঘাট, কত মানুষ আসতো যেত, কিভাবে নদী ছিল জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
তোষা নদীর যৌবন ফিরে আসবে কি না, কেউ জানে না। তবে মানুষ যতদিন থাকবে, ততদিন তোষার বুকে লুকিয়ে থাকা স্মৃতিগুলো জেগে থাকবে-- একসময়ের ব্যস্ত নৌঘাট ও সোনালি দিনের নদীজীবনের গল্প হয়ে ।