রংপুর প্রতিনিধিঃ
একসময় বৃহত্তর রংপুর অঞ্চল মানেই ছিল জাতীয় পার্টির (জাপা) অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্ত ঘাঁটি। ‘লাঙ্গলের ঘাঁটি’ হিসেবে পরিচিত এই অঞ্চলে জাতীয় পার্টিকে রাজনৈতিকভাবে অটল দুর্গ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
কিন্তু বিগত এক দশকে সেই দুর্গে একের পর এক আঘাত হানে পতিত আওয়ামী লীগ। এর ফলে রংপুর বিভাগের অধিকাংশ সংসদীয় আসন হারিয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়ে জাতীয় পার্টি। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে একপর্যায়ে জাতীয় পার্টির নির্বাচন অংশগ্রহণ নিয়েই তৈরি হয় অনিশ্চয়তা।
রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, আন্দোলন–পরবর্তী বাস্তবতা ও দলের অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েনে দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তবে রংপুর-৩ আসনে চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের মনোনয়নপত্র সংগ্রহের মধ্য দিয়ে সেই সংশয়ের অবসান ঘটে।
এর পরপরই রংপুর বিভাগের ছয়টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে জাতীয় পার্টি, যা দলীয় রাজনীতিতে নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করে। বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত রংপুর-২ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য আনিসুল ইসলাম মণ্ডল।
২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে বিজয়ী হওয়া এই নেতা স্থানীয়ভাবে পরিচিত ও দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। দলের নীতিনির্ধারকদের মতে, হারানো ঘাঁটি পুনরুদ্ধারে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য প্রার্থী ছাড়া বিকল্প ছিল না। সেই বিবেচনায় আনিসুল ইসলাম মণ্ডলকেই এগিয়ে রাখা হয়েছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জাতীয় রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন আসে।
জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তি জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের সহযোগী বা দোসর হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা চালায়। তবে জাতীয় পার্টির নেতারা সেই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলছেন, জুলাই আন্দোলনের সময় ছাত্র–জনতার পাশে মাঠে ছিল জাতীয় পার্টি। রংপুরে আন্দোলনের সময় জাতীয় পার্টির একাধিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন এবং জেলও খাটেন।
সে সময় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য ভর্ৎসনাও করা হয়। এই বাস্তবতা তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ও ক্ষত তৈরি করলেও, নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত হওয়ার পর সেই ক্ষত ধীরে ধীরে শক্তিতে রূপ নিচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দীর্ঘদিন আড়ালে থাকা জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা এখন আবার মাঠে।
ইউনিয়ন, ওয়ার্ড ও উপজেলা পর্যায়ে বৈঠক, গণসংযোগ ও সাংগঠনিক তৎপরতা বেড়েছে। দলীয় সূত্র জানায়, নির্বাচনের ঘোষণার পর থেকেই তৃণমূলে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। বদরগঞ্জ উপজেলা জাতীয় পার্টির সদস্য বজলুর রশিদ বুলেট বলেন, রংপুর বরাবরই জাতীয় পার্টির এলাকা।
কিছু সময়ের জন্য ঘাঁটি দুর্বল হলেও এখনো মানুষের মনে লাঙ্গলের জায়গা আছে। দল যোগ্য ও ত্যাগী প্রার্থী দিয়েছে। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে জাতীয় পার্টি আবারও স্বগৌরবে হারানো আসন ফিরে পাবে। রংপুর-২ আসনে এবারের নির্বাচন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে জটিল ও বহুমাত্রিক।
দীর্ঘদিন পর বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো সংগঠিতভাবে মাঠে নেমেছে। একই সঙ্গে শক্ত অবস্থানে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী। ইতিমধ্যেই ইসলামি ৮ দলেই যোগ দিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সহ আরো ৭ টি দল সেই ক্ষেতে এ আসন জামাত কে ছেড়ে দিবে বাকি ইসলামিক দলগুলো।
জোট বিহীন জাকের পার্টি, এবং সদ্য বিএনপির সাথে ২ আসন সমঝোতা করেছে গণঅধিকার পরিষদ এ দিক দিয়ে এই আসন দলীয় নেতাদের উপর নির্ভর করছে প্রার্থী দেয়া। এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জামাতের সাথে আলোচনা করছে সেক্ষেত্রে সমঝোতা হলে এ আসনে প্রার্থী না দেয়ার সম্ভাবনা বেশি। পাশাপাশি আরও যে ছোট রাজনৈতিক দল গুলো আছে সেগুলো থেকেও এখনো প্রার্থী দেয়নি।
প্রার্থী ঘোষণা বা আগ্রহ দেখিয়ে আসনটিকে ত্রিমুখী নয়, বরং বহুমুখী প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই আসনের রাজনৈতিক ইতিহাস দোলাচলে ভরা। ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগ, ১৯৭৯ সালে বিএনপি, ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগ, ১৯৮৮ ও ১৯৯১ সালে জাতীয় পার্টি, ১৯৯৬ সালে আবার আওয়ামী লীগ এবং ২০০১ সালে ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এভাবে বারবার ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে।
২০০৮ সালে জাতীয় পার্টির আনিসুল ইসলাম মণ্ডল বিজয়ী হলেও ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরী ডিউক টানা তিনবার নির্বাচিত হন। তবে বর্তমান বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় দলটি সরাসরি নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় নেই।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে ভোটার ছিল ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৪৬ জন। ত্রয়োদশ নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৭৯ হাজার ৯৩৪ জন।
নতুন যুক্ত হওয়া ২২ হাজার ৮৮৮ ভোটার নির্বাচনের ফলাফলে বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। জাতীয় পার্টির প্রার্থী আনিসুল ইসলাম মন্ডল বলেন, রংপুর-২ আসন আমার রাজনৈতিক শিকড়। আমি এই এলাকার মানুষের সুখ–দুঃখের সঙ্গী। হারানো আস্থা ও ঘাঁটি পুনরুদ্ধার করাই আমার লক্ষ্য।
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জনগণই লাঙ্গলের পক্ষে রায় দেবে। তিনি আরও বলেন,আমি ক্ষমতার রাজনীতি নয়, মানুষের অধিকার ও উন্নয়নের রাজনীতি করতে চাই। সকল শ্রেণি–পেশার মানুষের সহযোগিতায় বিজয়ের ব্যাপারে আমি আশাবাদী। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই উত্তপ্ত হচ্ছে রংপুর-২ আসনের রাজনীতি।
হারানো ঘাঁটি উদ্ধারে জাতীয় পার্টির মরিয়া প্রচেষ্টা, আনিসুল ইসলাম মণ্ডলের অভিজ্ঞতা এবং বহুমাত্রিক প্রতিযোগিতা। সব মিলিয়ে এই আসন এবারও নজরকাড়া লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।


