রম্য লেখক, আমিনুল হকঃ
বাংলা সঙ্গীতের ইতিহাসে নজরুল সঙ্গীত এক অনন্য সুরধারা—যা যুগে যুগে, কালে কালে বাঙালির হৃদয়ে ছুঁয়ে যায়। প্রেম, বিরহ, বেদনা ও ভক্তির অনুভূতি মিলেমিশে নজরুলের গানে গড়ে তুলেছে মানবমনের গভীরতম প্রকাশ। তাঁর সৃষ্টিগুলোয় যেমন বিদ্রোহের আগুন, তেমনি আছে এক নিভৃত আত্মার আর্তনাদ। সেই আর্তনাদেরই এক শাশ্বত রূপ যেন ধরা দিয়েছে গানে—“পথহারা পাখি কেঁদে ফিরে একা।”
গানটি শুনলে মনে হয়, এটি কোনো সাধারণ গীত নয়, বরং এক নিঃসঙ্গ আত্মার হাহাকার, যে হারিয়ে ফেলেছে নিজের ঠিকানা। প্রতিটি চরণ যেন জীবনের অন্ধকার পথে হেঁটে চলা এক পথিকের দীর্ঘশ্বাস—
“পথহারা পাখি কেঁদে ফিরে একা, আমার জীবনে শুধু আঁধারের লেখা।”
এখানে “পাখি” কেবল কবিতার একটি প্রতীক নয়—সে মানুষেরই প্রতিরূপ, যে হারিয়ে গেছে জীবনের অনিশ্চয়তা, একাকিত্ব ও বেদনার অরণ্যে। নজরুল তাঁর কাব্যিক ভাষায় এই হারানোর যন্ত্রণা ও আত্ম-অনুসন্ধানের সুরকে পরিণত করেছেন এক অপূর্ব শিল্পে।
স্বনামধন্য শিল্পী ফেরদৌস আরা যখন গানটি গেয়েছেন, তখন সেই ব্যথা যেন আরও গভীরভাবে অনুরণিত হয়েছে। তাঁর গায়কিতে প্রেমিক নজরুলের মর্মবেদনা রূপ নিয়েছে এক নীরব, মধুর বিষাদে। প্রতিটি সুর যেন শ্রোতার অন্তরে বাজে এক দীর্ঘশ্বাসের মতো। ফেরদৌস আরার কণ্ঠে এই গানটি কেবল শোনার বিষয় নয়—এটি অনুভবের বিষয়।
গানটিতে নেই কোনো অতিরঞ্জন, নেই সুরের জটিলতা—বরং আছে এক নিস্তব্ধ গভীরতা। সেই গভীরতা শ্রোতাকে নিয়ে যায় আত্মার ভেতরে, যেখানে হারিয়ে যাওয়া মানে শেষ নয়, বরং এক নতুন খোঁজের শুরু।
“পথহারা পাখি” তাই কেবল প্রেম-বিরহের গান নয়—এটি এক চিরন্তন মানবীয় অনুভূতির প্রতীক। এটি হারিয়ে যাওয়ার, ফিরে আসার, আর না-পাওয়ার যন্ত্রণার এক সংগীতায়িত অভিব্যক্তি। আজকের যান্ত্রিক জীবনে, যেখানে মানুষ ক্রমেই একা হয়ে যাচ্ছে, এই গান আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানুষ আসলে কত অনিশ্চিত নিজের পথের যাত্রী।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিতে যেমন জীবনের বেদনা, তেমনি আছে মুক্তির সুর। “পথহারা পাখি কেঁদে ফিরে একা” গানটি সেই মুক্তি ও বেদনার সংমিশ্রিত প্রতিচ্ছবি—যেখানে সুর, কথা ও কণ্ঠ মিলে সৃষ্টি করেছে অমর শিল্প।
আজও ফেরদৌস আরার কণ্ঠে যখন গানটি বাজে, মনে হয়—সেই পথহারা পাখিটি আমাদের মনের আকাশে উড়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলে যায়, “ফিরে যা, আপন নীড়ে।”


