রম্য লেখক, আমিনুল হকঃ
বাংলা লোকসঙ্গীতের ইতিহাসে কিছু গান আছে, যা কেবল সঙ্গীত নয়—গ্রামবাংলার স্পন্দন, মানুষের অনুভব আর প্রকৃতির প্রতিচ্ছবি হয়ে বেঁচে আছে যুগ যুগ ধরে। সেইসব অমর সৃষ্টির অন্যতম হলো “ও ধীরে ধীরে ধীরে ভাটির গাঙে যাও তরনি বাইয়া”। সময়ের সীমারেখা পেরিয়ে আজও এই গান মানুষের হৃদয়ে নদীর মতোই বহমান। আর যখন এটি ভেসে আসে আবদুল আলীমের দরাজ কণ্ঠে, তখন গানটি হয়ে ওঠে চিরন্তন—অমর।
বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের ইতিহাসে আবদুল আলীম কেবল একজন শিল্পী নন, তিনি এক যুগের প্রতীক। তাঁর কণ্ঠে ভাটিয়ালী, পল্লীগীতি ও মারফতি গান পায় প্রাণের গভীরতা, পায় মাটির গন্ধ। নদীমাতৃক এই বাংলার আত্মা যেন কথা বলে তাঁর প্রতিটি গানে। তাঁর গানে শোনা যায় মাঝির বাঁশির সুর, ভাটার টানের গতি, আর গ্রামীণ জীবনের সহজ সরল ছন্দ।
“ও ধীরে ধীরে ধীরে ভাটির গাঙে যাও তরনি বাইয়া”—এই ভাটিয়ালী গানে ধরা পড়েছে জীবনেরই এক দর্শন। এখানে নদী কেবল প্রকৃতি নয়, সে জীবনের প্রতীক। নদী যেমন ভাটার টানে ধীরে ধীরে বয়ে যায়, তেমনি মানুষের জীবনও সময়ের স্রোতে এগিয়ে চলে ধীর, নিশ্চুপ পথে। গানের সুরে তাই মিশে আছে এক অজানা গন্তব্যের আহ্বান, এক নীরব তৃষ্ণা, এক অবিনশ্বর যাত্রা।
আবদুল আলীম তাঁর কণ্ঠের জাদুতে এই গানে এমন প্রাণ সঞ্চার করেছেন, যা শ্রোতাকে নিয়ে যায় অন্য এক জগতে—যেখানে সময় থেমে যায়, শুধু বয়ে চলে সুর আর নদী। তাঁর গলায় এই গানের প্রতিটি শব্দ যেন জেগে ওঠে জীবন্ত হয়ে, যেন দেখা যায় সূর্যাস্তের আলোয় ভেসে চলা তরনি, মাঝির মন্থর বাঁশি, আর নদীর স্নিগ্ধ হাহাকার।
আজও যখন এই গানটি বাজে—রেডিও, টেলিভিশন কিংবা ইউটিউবের পর্দায়—তখন মনে হয়, বাংলার মাটির গন্ধ মিশে আছে প্রতিটি সুরে, প্রতিটি কথায়। নবীন প্রজন্মের কাছেও গানটি জনপ্রিয়তা হারায়নি; বরং হয়ে উঠেছে বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক।
“ও ধীরে ধীরে ধীরে ভাটির গাঙে যাও”—এই সুর যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জীবনেরও এক ভাটির টান আছে। নদীর মতোই আমরা সবাই এক যাত্রাপথের যাত্রী, গন্তব্য অজানা, কিন্তু সুর আমাদের পথ দেখায়। আর সেই সুরের মধ্যেই বেঁচে আছেন আবদুল আলীম—বাংলার লোকসঙ্গীতের চিরজাগ্রত আত্মা।


