রম্য লেখক, আমিনুল হকঃ
গ্রামবাংলা মানেই পাখির কূজন, সোনালি ফসলের মাঠ, চারদিক জুড়ে বৃক্ষ, লতা, পাতা আর ভোরের কোমল হাওয়া। এই প্রকৃতির সুরভিত সৌন্দর্যের মাঝে যে পাখিটির নাম সবার আগে মনে পড়ে, তা হলো ঘুঘু—ছোটখাটো গড়নের, ধূসর পালকের, শান্ত স্বভাবের এক চেনা পাখি।
ভোরবেলা কিংবা বিকেলবেলার নিস্তব্ধ পরিবেশে যখন শোনা যায়, “ঘুঘু উট্টু, ঘুঘু উট্টু”—সেই সুরে ভরে যায় মনের প্রান্তর। গ্রামীণ জীবনের ছন্দে ঘুঘুর ডাক যেন এক নৈসর্গিক সঙ্গীত—ভোরের শুরু কিংবা গোধূলির শেষ সঙ্কেত। কারও কাছে এটি ভালোবাসার বার্তা, কারও কাছে একাকিত্বের সুর।
সম্প্রতি আমার সহকর্মী আদনান বসুনিয়া তাঁর অফিস কক্ষে এমনই এক ঘুঘুর আগমন দেখেছেন। পরম মমতায় ঘুঘুটি এসে বসেছিল জানালার ধারে, কিছু ছবি তোলার পর সেটিকে আবার ছেড়ে দেওয়া হয় নিজের নীড়ে। এই দৃশ্য যেন মানুষ ও প্রকৃতির এক আন্তরিক সম্পর্কের প্রতীক—যেখানে ভালোবাসা মানে মুক্তি, নয় বন্দিত্ব।
বাংলার লোকজ সংস্কৃতিতে ঘুঘু শুধু একটি পাখি নয়; এটি হয়ে উঠেছে প্রতীক ও প্রতিচ্ছবি। বহু প্রবাদে, গানে ও কথায় ঘুঘুর উপস্থিতি পাওয়া যায়। যেমন জনপ্রিয় প্রবাদ—“ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখনি।” এর অন্তর্নিহিত অর্থ গভীর—বাহ্যিক সৌন্দর্যে মানুষ মুগ্ধ হয়, কিন্তু ভেতরের বিপদ বুঝে না। জীবনের বাস্তবতা এখানেই—সব কিছু যেমন দেখা যায়, তেমন নয়।
আরেকটি প্রাচীন কথা, “ঘুঘু চড়ান।” এটি বোঝায় প্রেম বা অনুরাগ প্রকাশের এক রোমান্টিক প্রতীক। একসময় গ্রামের তরুণেরা প্রিয়জনের মন জয়ের প্রতীক হিসেবে এই শব্দটি ব্যবহার করত। ফলে ঘুঘু বাঙালির লোকজ প্রেম-ভাষারও অংশ হয়ে উঠেছে।
ঘুঘু সাধারণত ঝোপঝাড়, গাছের ডাল বা নিরিবিলি জায়গায় জুটি বেঁধে বাসা বাঁধে। ডিম দেয় দুই-তিনটি, আর দম্পতি মিলে তা দেয়, বাচ্চা ফুটায়। এদের পারিবারিক বন্ধন প্রকৃতির কাছ থেকে শেখার মতো। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আজকের দিনে ঘুঘুর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বন-ঝোপঝাড় ধ্বংস, কৃষিজমিতে অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার ও খাদ্যের অভাব তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবুও এখনো বাংলার মাঠে-প্রান্তরে, ধানক্ষেতে কিংবা বাড়ির আঙিনায় যখন ভেসে আসে ঘুঘুর ডাক, মনে হয়—প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের চিরন্তন বন্ধন এখনো সম্পূর্ণ ছিন্ন হয়নি।
ঘুঘু আমাদের লোকজ জীবনের সদস্য, আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ভাবনার প্রতিচ্ছবি। “ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখনি”—এই প্রবাদটি যেমন শেখায় জীবনের বাস্তবতা বুঝতে, তেমনি মনে করিয়ে দেয়—প্রকৃতির প্রতি আমাদের ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধই আমাদের সত্যিকার মানবিকতা।
ঘুঘুর সুরে তাই বাজে বাংলার মাটি ও মানুষের চিরন্তন গল্প—ভালোবাসা, সতর্কতা আর জীবনের নীরব সৌন্দর্যের গল্প।


