বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী নাফ নদীতে জেলেদের অপহরণের ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে, যা স্থানীয় জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে চরম আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। মিয়ানমারের বিদ্রোহী গ্রুপ আরাকান আর্মি (এএ) কর্তৃক অভিযুক্ত এই অপহরণগুলোতে গত আট মাসে কমপক্ষে ২৩০ থেকে ৩০০ জেলেকে অপহৃত করা হয়েছে, যাদের মধ্যে অনেককেই বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সহায়তায় উদ্ধার করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে অপহরণের সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে, যা সীমান্ত অঞ্চলের উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
গত তিন সপ্তাহে (আগস্ট মাসের মাঝামাঝি থেকে শেষ সপ্তাহ) আরাকান আর্মি কর্তৃক কমপক্ষে ৪৬ জেলেকে অপহৃত করা হয়েছে, যাদের সাথে কয়েকটি মাছ ধরার ট্রলারও ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো নিম্নরূপ:
২৩ আগস্ট ২০২৫ টেকনাফের নাইখ্যাংদিয়া এলাকায় নাফ নদী থেকে ১২ জেলেকে অপহৃত করা হয়। অপহৃত জেলেরা হলেন: আলী আহমেদ (৩৯), মোহাম্মদ আমিন (৩৪), ফজল করিম (৫২), কেফায়েত উল্লাহ (৪০), সাইফুল ইসলাম (২৩), সাদ্দাম হোসেন (৪০), রাসেল (২৩), সোয়াইব (২২), আরিফ উল্লাহ (৩৫), মোহাম্মদ মোস্তাক (৩৫) এবং নুরুল আমিন (৪৫)। তারা বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ ধরে ফেরার পথে ছিলেন যখন আরাকান আর্মির সদস্যরা তাদের ট্রলারসহ ছিনিয়ে নেয়। স্থানীয় জেলে ও ট্রলার মালিকরা এই অভিযোগ করেছেন। বিজিবি সূত্রে জানা যায়, গত আট মাসে এই ধরনের অপহরণে ২৩০ জেলে জড়িত, যাদের মধ্যে ২০০ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ আহসান উদ্দিন জানিয়েছেন, অপহৃতদের দ্রুত ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।
২৫ আগস্ট ২০২৫ নাফ নদীতে আরও ৭ জেলেকে অপহৃত করা হয়, যা গত তিন দিনের মধ্যে অপহরণের সংখ্যাকে ৩৩-এ পৌঁছে দেয়। এই ঘটনায় একটি মাছ ধরার ট্রলারও ছিনিয়ে নেয়া হয়।
২৬ আগস্ট ২০২৫ ১১ থেকে ১৩ জেলেকে দুটি ট্রলারসহ অপহৃত করা হয়। এই ঘটনাগুলোতে স্থানীয় জেলে সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম জানিয়েছেন, ১৩ থেকে ২৬ আগস্টের মধ্যে ৪৪ জেলে এবং ৬টি ট্রলার অপহৃত হয়েছে।
২৯ আগস্ট ২০২৫ বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড শাহপরির দ্বীপের কাছে নাফ নদীতে প্যাট্রোলিংয়ের সময় ১৯টি ট্রলারসহ ১২২ জেলেকে আটক করে, যাদের মধ্যে ৯৩ জন রোহিঙ্গা এবং ২৯ জন বাংলাদেশী। কোস্ট গার্ডের অভিযোগ, তারা মিয়ানমারের জলসীমায় প্রবেশ করেছিল। তবে জেলেরা দাবি করেছেন, তারা সীমান্ত অতিক্রম করেননি এবং মাছ ধরে ফেরার পথে আটক হয়েছেন। কোস্ট গার্ডের লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সালাহউদ্দিন রাশিদ তানভীর জানিয়েছেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের চলমান সংঘর্ষের কারণে আরাকান আর্মি সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করছে এবং প্রায়শই বাংলাদেশী জেলেদের আটক করছে। গত চার দিনে ৪৬ জেলেকে আরাকান আর্মি অপহরণ করেছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

নাফ নদী বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যে একটি প্রাকৃতিক সীমান্ত, যা টেকনাফ উপজেলার জেলেদের জীবিকার প্রধান উৎস। তবে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ, বিশেষ করে আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ, এই অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়িয়েছে। আরাকান আর্মি ২০১৫ সাল থেকে রাখাইন রাজ্যে লড়াই করছে এবং ২০২৩ সাল থেকে সংঘর্ষ তীব্র হয়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তারা মাউংডাও টাউনশিপসহ সীমান্তবর্তী এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে নেয়।
২০১৭ সালের রোহিঙ্গা সংকটের পর থেকে নাফ নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধ ছিল, যা ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তুলে নেয়া হয়। তবে আরাকান আর্মি জেলেদেরকে তাদের জলসীমায় প্রবেশের অভিযোগে অপহরণ করছে। ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ ২০২৫-এ যথাক্রমে ১৫ এবং ৫৬ জেলেকে অপহৃত করা হয়, যাদের পরে উদ্ধার করা হয়। মে মাসে মোহাম্মদ সিদ্দিকীসহ তিনজনকে অপহৃত করে হাতকড়া পরানো এবং মারধর করা হয়। আরাকান আর্মি নিজেদেরকে বৈধ কর্তৃপক্ষ বলে মনে করে এবং এই অপহরণগুলোকে ‘আইন প্রয়োগ’ বলে দাবি করে, যদিও বাংলাদেশ এটিকে অবৈধ বলে মনে করে।
এই অপহরণগুলো টেকনাফের ৪,০০০-এর বেশি ট্রলার মালিক এবং জেলেদের জীবিকাকে বিপন্ন করেছে। জেলেরা গভীর সমুদ্রে যেতে ভয় পাচ্ছেন, যার ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। আরাকান আর্মির প্যাট্রোলিং এবং গুলিবর্ষণের ঘটনাও রিপোর্ট হয়েছে। বিজিবি এবং কোস্ট গার্ড অপহৃতদের উদ্ধারে কাজ করছে, তবে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে কারণ আরাকান আর্মি একটি অ-রাষ্ট্রীয় গ্রুপ। আরাকান আর্মি কিছু অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
স্থানীয় জেলে সমিতির নেতারা সরকারের কাছে সীমান্তে নিরাপত্তা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন। এই ঘটনাগুলো সীমান্ত উত্তেজনাকে আরও জটিল করে তুলেছে, যা রোহিঙ্গা সংকটের সাথে জড়িত। সরকারী সূত্র জানিয়েছে, অপহৃতদের ফিরিয়ে আনার জন্য কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে চেষ্টা চলছে।


