ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা,
ওরে সবুজ, ওরে অবুজ,
আধ-মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।
যুগে যুগে কবি সাহিত্যিকেরা এভাবেই নবীন, তরুনদের আহবান করে গেছেন। তাঁরা যেন বুড়োদের বাঁচান, পথ দেখান। প্রয়োজনে আঘাত করে হলেও যেন বুড়োদের জাগ্রত করেন। যুগে যুগে এই তরুনরাই বুকের তাজা রক্ত দিয়ে সমাজ, দেশ তথা পৃথিবীর জঞ্জাল সাফ করে গেছেন। বড় বড় পরিবতনগুলো তরুনদের মাধ্যমেই এসেছে। হালদিনে দেশের ক্রান্তিলগ্নে এই তরুনরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করে স্বৈরাচারকে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে। আজকে আরেক দল তরুনকে নিয়ে লেখতে হচ্ছে যারা কিনা অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে নিজের জীবন, পরিবার, সমাজ, দেশকে বিশাল ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
অনলাইন প্লাটফর্মে প্রবেশ করলেই দেখা যায় শতশত অনলাইন জুয়ার অ্যাপ। চটকদার বাহারি সব বিজ্ঞাপনের পসরা। এতে ব্যবহার করা হয় জনপ্রিয় সব অভিনেতা,খেলোয়ার,কোন কোন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্বে থাকা প্রভাবশালী মানুষজনের ছবি এবং নকল কষ্ঠ। বিজ্ঞাপনে তারা বলছেন আপনি কি পুঁজি ছাড়াই লাখ লাখ টাকার মালিক হতে চান? তাহলে এই অ্যাপটি এখনই ইন্সস্টল করুন, খেলুন এর জিততে থাকুন লাখ লাখ টাকা। কিভাবে অ্যাপ ডাউনলোড করবেন, কিভাবে খেলবেন, টাকা উইথড্র’র নিয়ম, কোন ব্যাংক বা কোন মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে টাকা পাঠানো হবে এসবের বিস্তারিত থাকে এই বিজ্ঞাপনে। কোন কোন বিজ্ঞাপনে এমন অফারও থাকে যেখানে বলা হয় তাদের অ্যাপ শুধু ডাউনলোড করলেই ফ্রী কিছু টাকা দেওয়া হবে! এসব অ্যাপের মধ্য এফবি৭৭, সিকে৪৪৪, এমজি ০০৭, আইপিএল-বিপিএল ক্রিকেট টুর্নামেন্টকে কেন্দ্র করে বেট৩৬৫, মেইলবেট, এক্সবেট, ওয়ান এক্সবেট, মাইজেট, ক্রিকেক্স, বেইটউইনার ইত্যাদি।
এসব চটকদার বিজ্ঞাপনে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট হয় তরুন যুবকরা। এখন শুধ তরুনদের মধ্যই অনলাইন জুয়া সীমাবদ্ধ নাই। দেশের প্রতিটি শ্রেনী-পেশার মধ্য ছড়িয়ে পড়েছে। দিনমজুর থেকে ভ্যান চালক, চাকুরিজীবী থেকে ব্যবসায়ী সকলেই অনলাইন জুয়াতে বুদ হয়ে আছে। ভয়ঙ্কর তথ্য হলো শিক্ষকদের মধ্য অনেকেই এই নেশায় যুক্ত হয়েছে। গ্রাম কিংবা শহর। চায়ের দোকান, রেস্তেরা, রেলস্টেশন, খেলার মাঠ, স্কুল কলেজসহ সবজায়গায় সমানতালে একদল মানুষ মোবাইল ফোন সামনে ধরে ভাবলেশহীন খেলে যাচ্ছে।
সমীর (ছদ্ম নাম) কলেজে পড়েন, থাকেন মেসে। বাড়ি থেকে যে টাকা পাঠায় তাঁর বাবা সেই টাকায় আর চলছে না, এখন বাড়তি ইনকামের জন্য টিউশনি করছে। সে বলছে এটা এমন এক জগৎ যেখানে প্রবেশ করলে আর বেরুনো যায় না। গত একমাসে সে জুয়া খেলে জিতেছে ১২ হাজার টাকা। অপরদিকে হেরেছে ১৫ হাজার টাকা। একই চিত্র দেখা যায় ভ্যানচালক জহির (ছদ্ম নাম) এবং দিনমজুর অখিল (ছদ্ম নাম) এর ক্ষেত্রে। এই জুয়ার শুরু হয় ধনী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে শেষ হয় নিঃস্ব হয়ে।
বিভিন্ন গবেষনা প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে বাংলাদেশে প্রায় ৬৫ লক্ষ্য মানুষ অনলাইন জুয়ার সাথে যুক্ত। এরমধ্য ৭০ভাগই তরুন যুবক। এই জুয়াড়ির সংখ্যা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। টিআইবি গত বছর দেশের তরুন ও যুব সমাজকে অনলাইন জুয়ার কবল থেকে রক্ষার জন্য অনলাইনে জুয়ার বিজ্ঞাপন বন্ধের দাবি জানিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছিল। টিআইবি বলেছিলো দেশে অনলাইন জুয়ার প্রসারে মোবাইল ব্যাংকিং একটি বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে। শুধু আইপিএল, বিপিএল মৌসুমেই ১১০০-এর বেশি মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট অনলাইন জুয়ার লেনদেনে জড়িত থাকার প্রমান পাওয়া গেছে। অথচ মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এসব বন্ধে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না,তারা শুধু এসএমএস পাঠিয়ে দায় সারছে।
দেশে জুয়ার আথিক বাজার কত?
সিআইডি’র তথ্যানুসারে দৈনিক মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে ৫-১০ কোটি টাকা এবং সরাসরি ব্যাংক চ্যানেলে ৩০-৫০ কোটি টাকা। আমরা যদি একটি গড় করি তাহলে দৈনিক লেনদেনের সম্ভাব্য একটি হিসাব পাবো। গড় হিসাবে ধরলে দৈনিক ৪০ কোটি টাকার লেনদেন হয়, সেই হিসেবে মাসে ১২০০ কোটি টাকা এবং বছরে ১৪ হাজার ৪শত কোটি টাকা। যদিও বিভিন্ন পত্রিকা তাঁদের নিজস্ব জরিপে বলছেন এইটা বছরে ১৮ হাজার কোটি টাকা। অথচ মাত্র ৮ হাজার কোটি টাকার জন্য নাকি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে প্রতিবছর নাকি হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে এই অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে। এই জুয়ার অধিকাংশ সাইড চীন, রাশিয়া, দক্ষিন কোরিয়া থেকে অপারেট হয়।
এই অনলাইন জুয়া আসক্তির প্রধান কারণ হলো-আথিক লোভ, বেকারত্ব, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব, মানসিক কারণ, জুয়ার সহজলভ্যতা এবং যথাযথ আইন প্রয়োগের দূবলতা।
এই আসক্তির ফলে পারিবারিক কলহ বাড়ছে, ঋনগ্রস্থ হয়ে পড়ছে বেশির ভাগ জুয়াড়ি, কোন কোন ক্ষেত্রে সংসার ভেঙ্গে যাচ্ছে। শিক্ষাথীদের ক্ষেত্রে পড়া-লেখায় আগ্রহ হারাচ্ছে,ব্যথ হচ্ছে,উদ্বেগ,হতাশা এবং বিষন্নতায় ভূগছে। জুয়ার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে,ফলে কিশোর অপরাধ থেকে শুরু করে সমস্ত অপরাধের সংখ্যা বাড়ছে। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন নষ্ট হচ্ছে।
প্রতিরোধের উপায় কি?
১.পরিবার: পবিবার হচ্ছে সন্তানের প্রথম পাঠশালা,পরিবার থেকেই শিশুরা নৈতিক শিক্ষা লাভ করে থাকে। একমাত্র পরিবারই পারে তার সন্তানকে নৈতিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে। একই সাথে সন্তানের হাতে স্মাটফোন তুলে দিলেই হবে না, সন্তান ফোনে কি করছে,কি দেখছে,কত সময় ফোনে সময় দিচ্ছে,কাদের সাথে চলাফেরা করছে,হঠাৎ করে সন্তানের টাকার চাহিদা বাড়ছে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখা। সন্তানের আচরণে কোন বড় ধরনের পরিবতন হচ্ছে কিনা হলে কেন হচ্ছে। সেটা নিয়ে সন্তানের সাথে কথা বলা,প্রয়োজনে কাউন্সেলিং করা। মোবাইল এর ব্যবহার কমিয়ে বই পড়ার অভ্যেস গড়তে পারিবারিক পাঠাগার গড়ে তোলা।
২.সামাজিক: মানুষ সামাজিক জীব,ফলে কোন মানুষই সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে বেঁচে থাকতে পারে না। একটি শিশু কেমন হয়ে বড় হবে,সে নৈতিকতা সম্পূন মানুষ হবে নাকি অনৈতিক মানুষ হবে তার অনেকটায় নিভর করে সমাজের উপর। জুয়ার ভয়াবহতা,সামাজিক অবক্ষয়তা ইত্যাদি বিষয়ে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্কুল,কলেজ,মাদরাসায় ব্যাপক প্রচার প্রচারনা চালাতে হবে। খেলা-ধুলা,সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে সামাজিকভাবে।
৩.আইন প্রয়োগ: আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজরদারী বাড়াতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতারক চক্রের মূল হোতাদের শাস্তি প্রদান করতে হবে। মোবাইল ব্যাংকিং এবং ব্যাংকগুলোকে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।


