রম্য লেখক, আমিনুল হকঃ
গ্রামগঞ্জে বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ— “বৃক্ষ তোমার নাম কী, ফলে পরিচয়”। কিন্তু এই বৃক্ষটির পরিচয় ফলে নয়, বরং আকার-আয়তন, শাখা-প্রশাখা ও বিশালতায়। নাম তার বটবৃক্ষ।
আদিম যুগ থেকেই হাজার বছরের ঐতিহ্যের সাক্ষী বটবৃক্ষ। শুধু প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যের সৌন্দর্যই নয়, বটগাছ হয়ে উঠেছে সামাজিক সংস্কৃতি, লোকায়ত ঐতিহ্য ও ঐক্যের প্রতীক। গ্রামীণ বাংলার মেঠোপথের ধারে, তিন রাস্তার মোড়ে কিংবা চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা মহীরুহ বটবৃক্ষের শাখা-প্রশাখা ও ঝুরি মানুষকে মোহিত করেছে যুগে যুগে।
বটগাছের তলে বসত গ্রামীণ হাটবাজার। হতো লোকজ উৎসব, মেলা, সভা-সমাবেশ আর জনসমাগম। ক্লান্ত পথিক ছায়াতলে বসে নিত বিশ্রাম, শান্তির শ্বাস ফেলত এর ছায়ায়। তাই তো জাতীয় সংগীতের মধ্যেও বটবৃক্ষ বাঙালির দেশপ্রেমে প্রেরণা জাগায়।
বাংলা সাহিত্যেও বটবৃক্ষ অনুপ্রেরণার উৎস। গল্প, উপন্যাস, কবিতা কিংবা পৌরাণিক কাহিনীতে এর উল্লেখ বারবার এসেছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ কিংবা নজরুল ইসলাম—সবাই তাঁদের লেখনীতে বটগাছের মাহাত্ম্য অঙ্কন করেছেন। কথিত আছে, ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বটগাছের ছায়াতলে বসেই নজরুল বাঁশি বাজাতেন এবং দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করতেন। আজও কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সেই বটগাছ দাঁড়িয়ে আছে কবির স্মৃতি হয়ে।
হিন্দুধর্মাবলম্বীরা বটগাছকে পূজনীয় মনে করেন। তারা বিশ্বাস করেন, এটি পবিত্রতার প্রতীক। অন্যদিকে, এর ভেষজ গুণের কারণে গ্রামবাংলার মানুষের কাছে বটগাছ সমাদৃত। পাখিদেরও এটি অন্যতম নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আজ বটবৃক্ষ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি থেকে। উন্নয়নের নামে নির্বিচারে নিধন, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও পরিবেশ ধ্বংসের ফলে বিলুপ্তির পথে মহীরুহ বটগাছ। আর যদি এ ধারা অব্যাহত থাকে, তবে প্রকৃতি হারাবে তার স্বাভাবিক ভারসাম্য, আর মানুষ ও প্রাণীকূল হারাবে বেঁচে থাকার অনুকূল পরিবেশ।
তাই এখনই প্রয়োজন বটবৃক্ষ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া। যাতে প্রাচীন ঐতিহ্যের সাক্ষী এই মহীরুহ শুধু স্মৃতিতে নয়, বাস্তবেও টিকে থাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।


