
“অভয়াশ্রম গড়ে তুলি, দেশী মাছে দেশ গরি” সরকার বাহাদুর ঢাক-ঢোল পিটিয়ে মৎস সপ্তাহ পালন করছে এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে। “মাছ ধরলে কই-মাগুর, জামাই ধরলে সভার ঠাকুর”, ”মাছের কিন মাও, গরুর কিন ছাও” অথবা মাছের জলে লাউ বাড়ে, ধেনো জমিতে ঝাল বাড়ে” ছোটবেলায় এরকম খনার বচন শুনতাম বাপ-দাদাদের মুখে। বর্ষাকালে খাল-বিল, নদী উপকূলের মানুষজন বাজার থেকে মাছ কিনতো না, খাল-বিল ভরা থৈথৈ পানি জাল ফেলতেই নানা জাতের দেশী মাছ, অথচ আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করছি মাছে-ভাতে বাঙ্গালীর পাতে মাছ নেই! বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তদের ক্রয় ক্ষমতার বাহিরে চলে গিয়েছে মাছের বাজার। চাষকরা মাছের দাম এখন আকাশ ছোঁয়া প্রত্যেক প্রকারের মাছে কেজি প্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। অবাক বিষয় মাছের খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো জানাচ্ছেন সব মৎস ফিড এর দাম কমেছে টন প্রতি প্রায় ৩ হাজার টাকা! তাহলে মাছের দাম না কমে বাড়ছে কেন?
শুধু কি ফিডের দামের কারণেই মাছের দাম বাড়ে? মোটেও না। এর জন্য বেশ কিছু নিয়ামক কাজ করে। বানিজ্যিক মাছ চাষের জন্য লিজ নেওয়া জলধারের দাম, রেনু পোনার দাম, শ্রমিকের মজুরী, পরিবহণ খরচ, পরিবহণ চাঁদাবাজি এবং মধ্যস্বত্তভোগী বা সিন্ডিকেট। অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদন ও চাহিদার ভারসাম্যে ফাটল ধরার কারণেও মাছের দাম বৃদ্ধি পায়। এবারের মাছের দাম বৃদ্ধি একেবারই ভিন্ন। সাধারনত বাংলাদেশে বর্ষাকালে জলাধার গুলোতে প্রচুর দেশী জাতের মাছ ধরা পড়ে। গত দু-বছরের তুলনায় এবার দেশে বৃষ্টি বেশি হবার কারণে প্রায় সবগুলো খাল-বিল, নদী-নালা পানিতে কানায় কানায় পূর্ন। ফলে দেশী মাছের জোগান গত দু-বছরের তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু গত বছরের তুলনায় এবারে দেশী মাছ বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে।
এর একমাত্র কারণ সিন্ডিকেট। বাংলাদেশে সিন্ডিকেট হয় মূলত চারভাবে- মজুদ ও ঘাটতির কারসাজি, ব্যবসায়ীদের মধ্য সমন্বয়তা, ক্রেতাদের মধ্য ভীতি ও গুজব সৃষ্টি করা, মৌসুমি সিন্ডিকেট।
মাছ বাজারের ক্ষেত্রে দুই নম্বর সিন্ডিকেট সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করে কৃত্রিম দাম বৃদ্ধিতে। এক্ষেত্রে পাইকার, আড়তদার, খুচরা বিক্রেতা সকলেই গোপন চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। তারা নিজেরা সমন্বয় করে সকল মাছের দাম র্নিধারন করে, ক্রেতাদের বাধ্য করা হয় র্নিদিষ্ট দামে মাছ কিনতে। বাজার সিন্ডিকেট ভাঙ্গার ব্যাপারে সরকারের উদাসীনতা এবং অকার্যকর পদক্ষেপও দাম বৃদ্ধির নিয়ামক ভূমিকা পালন করে।

দেশে মাছের চাহিদা কত?
পুষ্টিবিদদের মতে শারীরিক মানষিক বিকাশের জন্য অত্যান্ত গুরুত্বর্পূণ ভূমিকা পালন করে মাছ। বিশ্বের অন্যতম স্বাস্থ্যকর খাবার হচ্ছে মাছ। ভিটামিন ডি, প্রোটিন, আয়েডিন সহ প্রচুর পুষ্টিগুনে ভরপুর থাকে মাছে। দেশ বিদেশের গবেষকরা মনে করেন, একজন প্রাপ্ত বয়ষ্ক মানুষের প্রতিদিন ১০০গ্রাম মাছ খাওয়া প্রয়োজন। যদিও বাংলাদেশের গড়ে প্রতিদিন মাছ খা্য় ৬০ গ্রামের মতো। আমরা যদি ১০০ গ্রাম হারে প্রাপ্যতা হিসাবে ধরি তাহলে প্রতিবছর একজন মানুষের মাছের প্রয়োজন হয় ৩৬ কেজি। ধরে নিলাম বাংলাদেশে বর্তমানে জনসংখ্যা ১৭ কোটি । সেই হিসেবে দেশে মাছের চাহিদা হবে ৬,২২২,০০,০০০ কেজি বা ৬.২২২ মিলিয়ন টন (জনসংখ্যা কম-বেশি হলে মোট চাহিদা কম বা বেশি হবে)।
দেশে মাছের উৎপাদন কত?
বাংলাদেশ মৎস গবেষনা ইনস্টিউটের তথ্যমতে বাংলাদেশে ৪৮ লাখ টন মাছ উৎপাদন হয়।
বাংলাদেশ মৎস গবেষনা ইনস্টিউট বলছে ৪৮ লাখ টন মাছের মধ্যে চাষের মাছ ৩২ লাখ টন, খাল-বিল, নদী-নালা এবং উন্মক্ত জলাধার থেকে ১৩ লাখ টন (ইলিশসহ) এবং সমুদ্র থেকে ৩ লাখ টন মাছ আহরন করে। হিসেব করলে দেখা যায় প্রায় ১৪ লাখ টন মাছ কম উৎপাদন হয়। ঘাটতি বলার কারণ হলো এখন আমাদের মাছের প্রাপ্যতা হচ্ছে-৬০ গ্রাম দৈনিক কিন্তু আমাদের প্রয়োজন কমপক্ষে-১০০ গ্রাম দৈনিক। তাহলে এই ঘাটতি পূরণ হবে ক্যামনে ? হয় উৎপাদন বাড়াতে হবে অথবা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে। আমাদের চাহিদার অধিকাংশ যোগানদাতা চাষের মাছ। এই বানিজ্যিক মাছ চাষ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি কোন কোন অঞ্চলে দু ফসলি কোন জায়গায় তিন ফসলি জমি খনন করে মাছ চাষ করতে। রাজশাহী জেলার-মোহনপুর উপজেলা, বাগমারা উপজেলা, পুঠিয়া উপজেলা। নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলা, রানীনগর উপজেলা উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। অথচ আমরা ফসলি জমি নষ্ট না করেও আমাদের যে, ৭০০ নদ-নদী, খাল-বিল যার আয়তন ৯৩৮০ বর্গ কিমি, বর্ষাকালে সেই আয়তন প্রায় দ্বিগুন হয়ে যায় সেখানে সরকারি উদ্যোগে মাছ চাষ করতে পারলে বর্তমান চাহিদার দ্বিগুন মাছ উৎপাদন সম্ভব।
এক সময় আমাদের এই দেশে ছিলো ১২শ নদী আর হাজার হাজার খাল-বিল, হাওর-বাওর। উন্মুক্ত জলাশয়গুলো ছিলো নানা প্রজাতির মাছে ভরপুর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন একসময় দেশের নদী ও উন্মক্ত জলাশয়গুলোতে প্রায় ২৯০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। এথন সেটা নেমে এসেছে ১০০ প্রজাতিতে। নদী মরতে মরতে নদীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪০০টিতে। শুধু কি তাই বেঁচে থাকা নদীগুলো রক্ষা করা যাচ্ছে না দানব নদী খেকোদের হাত থেকে। একদিকে দখল অন্যদিকে দূষণ এই ভয়ঙ্কর ব্যাধি ক্যান্সারে রুপ নিয়েছে। সরকার বাহাদুর কুসুম কুসুম উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে নিজের দায় সারে। এখন পর্যন্ত কোন দখলবাজের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যায় নি। ফলে নদীর নাব্যতা কমছে, দূষন বাড়ছে মাছের প্রজননের হার কমছে।
সরকারের অপরিকল্পিত নীতির কারণে যত্রতত্র সুইচ গেট র্নিমান, নদীরক্ষা বাঁধ দিয়ে খাল-বিল, হাওর-বাওরে পানির অবাধ প্রবাহ বাধাগ্রস্থ করার ফলে উন্মুক্ত জলাশয় গুলো বদ্ধ ও নিশ্চল হয়ে পড়েছে। সাথে যুক্ত হয়েছে বানিজ্যিকভাবে মাছ চাষের নামে অবাধে পুকুর খনন, এখন বিলগুলো আর মুক্ত জলাশয় নেই হয়ে উঠেছে শতশত পুকুরের বিল। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে তারাই কোন আইনের ধার ধারে না, প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অবৈধভাবে পুকুর খনন করতে থাকে। জমিগুলোতে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মাছের ডিম বিনষ্ট হচ্ছে।
আমাদের ছোট্ট ভূখন্ড সীমিত সম্পদ এবং অতিরিক্ত জনসংখ্যা। এই দেশে প্রত্যেকটি সম্পদের সুষ্ঠ ব্যবহার করতে না পারলে একদিকে অপুষ্টি ও অনাহার এবং অন্যদিকে দিনকে দিন বেকারত্ব বাড়তে থাকবে।