
ঢাকার একটি কোচিং সেন্টারে পড়ুয়া কলেজছাত্রী নুসরাত (ছদ্মনাম) হঠাৎ করেই পড়াশোনায় মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। আগে ক্লাসে প্রথম সারিতেই থাকত সে, হাসিখুশি মেয়েটি বন্ধুদের প্রাণকেন্দ্র ছিল। কিন্তু কয়েক মাস ধরে তার আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। কারণ? ফেসবুকে তার ছবি ব্যবহার করে একটি ভুয়া অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। সেখানে একের পর এক কুরুচিপূর্ণ পোস্ট দেওয়া হচ্ছে। সহপাঠীরা হাসাহাসি করছে, পরিবার উদ্বেগে কাতর।
নুসরাত একদিন মায়ের কাছে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলে, “আমার মনে হয় আমি যদি বেঁচে না থাকি তাহলে হয়তো সবাই শান্তি পাবে।”
নুসরাতের মতো অসংখ্য কিশোর-কিশোরী প্রতিদিন এই সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে। কারও হাসি চাপা পড়ছে, কারও স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে। আর সমাজে দিন দিন ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে এই নীরব সন্ত্রাস।
তারকারাও রেহাই পান না
সাইবার বুলিং শুধু সাধারণ মানুষকে নয়, আলোচিত ব্যক্তিত্বদেরও ছাড় দিচ্ছে না। সম্প্রতি মডেল ও ফ্যাশন ডিরেক্টর এডলফ খান একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার জেতার পর সামাজিক মাধ্যমে নানাভাবে কটাক্ষের শিকার হন। বাবার জানাজাতেও তার পোশাক নিয়ে বিদ্রূপ করা হয়।
এ প্রসঙ্গে তৃতীয় লিঙ্গের কূটনীতিক ওয়ালিদ ইসলাম মন্তব্য করেন, “আমরা কি জন্মগতভাবেই মানুষের হাসির খোরাক? এটা কি আমাদের অপরাধ?”
ভয়াবহ মানসিক প্রভাব
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবা হক বলেন,
“কিশোর বয়সে পরিচয় সংকট বা আত্মমর্যাদা গড়ে ওঠে। এই সময়ে যদি কেউ বারবার বিদ্রূপ বা আক্রমণের শিকার হয়, তবে তার মানসিকতায় স্থায়ী ক্ষত তৈরি হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে ডিপ্রেশন, আত্মঘাতী প্রবণতা পর্যন্ত তৈরি হয়।”
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) এক গবেষণায় দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ৩০ শতাংশের বেশি কিশোর-কিশোরী অনলাইন বুলিংয়ের কোনো না কোনো অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে।
নীরব ভুক্তভোগীরা
ঢাকার গুলশানের একটি স্কুলের শিক্ষক জানান, সম্প্রতি তার এক শিক্ষার্থী পরীক্ষার হলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। পরে জানা যায়, সহপাঠীরা হোয়াটসঅ্যাপে তার ছবি এডিট করে কুরুচিপূর্ণ মিম বানিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছিল। লজ্জায় সে আর স্কুলে আসতে চায়নি।
একইভাবে খুলনার এক তরুণ চাকরিপ্রার্থী জানালেন, বিয়ের প্রস্তাব ভেস্তে যায় তার একটি ভুয়া ভিডিও অনলাইনে ভাইরাল হওয়ার পর। যদিও প্রমাণিত হয়েছে ভিডিওটি ফেক, কিন্তু সামাজিক অপমান তাকে ডিপ্রেশনে ঠেলে দিয়েছে।
আইন আছে, প্রয়োগ কম
সাইবার বুলিংয়ের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রয়েছে। এর আওতায় মানহানি বা ভুয়া তথ্য প্রচার করলে সাজা হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে বেশিরভাগ ভুক্তভোগী অভিযোগ করতেই ভয় পান।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
“আমরা অভিযোগ পেলেই তদন্ত করি। তবে ভুক্তভোগীদের অনেকে সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে চুপ থাকেন। এতে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।”
সমাজের করণীয়
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু আইন নয়, সমাজকেও দায়িত্ব নিতে হবে।
🔹 পরিবার : অভিভাবকরা সন্তানদের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করবেন। তারা যেন ভয়ে না থেকে সমস্যার কথা জানাতে পারে।
🔹 শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : স্কুল-কলেজে ডিজিটাল নিরাপত্তা বিষয়ে নিয়মিত আলোচনা ও কর্মশালা আয়োজন করা দরকার।
🔹 মিডিয়া ও সেলিব্রিটি : দায়িত্বশীল কনটেন্ট তৈরি ও সচেতনতা প্রচার করতে হবে।
🔹 আমরা সবাই : ট্রল বা বিদ্রূপ দেখে হাসাহাসি না করে প্রতিবাদ জানাতে হবে।
মনোবিজ্ঞানী ড. মাহবুবা হকের কথায়, “একটা নেতিবাচক কমেন্ট ভুক্তভোগীর কাছে তীরের মতো বিঁধে যেতে পারে। তাই অনলাইনে সহমর্মিতা দেখানোই প্রকৃত মানবিকতা।”
সাইবার বুলিং হয়তো চোখে দেখা যায় না, কিন্তু এর যন্ত্রণা বাস্তব জীবনের চেয়েও ভয়াবহ। এটি শুধু একজন মানুষকে নয়, পুরো সমাজকেই অসুস্থ করে তোলে। তাই এখনই আমাদের সবার সচেতন হতে হবে। আজকের নুসরাত যদি নিরাপদ না হয়, তাহলে আগামী দিনের বাংলাদেশও নিরাপদ নয়।
রনক