‘মুখ ও মুখোশ’ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের প্রথম পদক্ষেপ

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প, যা ‘ঢালিউড’ নামে পরিচিত, একটি সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ ইতিহাসের অধিকারী। এই শিল্পের সূচনা হয়েছিল একটি উল্লেখযোগ্য সিনেমার মাধ্যমে, যা বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র হিসেবে স্বীকৃত। সেই সিনেমা হলো ‘মুখ ও মুখোশ’, যা ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট মুক্তি পায়। এই প্রতিবেদনে আমরা এই ঐতিহাসিক সিনেমার পটভূমি, নির্মাণ প্রক্রিয়া, এর প্রভাব এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে এর তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করব।



১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) চলচ্চিত্র শিল্পের কোনো উল্লেখযোগ্য অস্তিত্ব ছিল না। ভারতীয় বাংলা সিনেমা, হিন্দি সিনেমা এবং হলিউডের ছবি তখন এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করত। স্থানীয়ভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রচেষ্টা ছিল সীমিত। এই সময়ে ঢাকায় সিনেমা হল ছিল, যেমন শাবিস্তান (পূর্বে পিকচার হাউস) এবং রূপমহল, কিন্তু স্থানীয়ভাবে নির্মিত কোনো পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ছিল না। ১৯৫৩ সালে একটি সভায় খান বাহাদুর ফজল আহমদের মন্তব্য, “পূর্ব পাকিস্তানের আর্দ্র আবহাওয়ায় চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব নয়,” এই অঞ্চলের চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রতি নেতিবাচক ধারণাকে প্রতিফলিত করে। এই মন্তব্যের প্রতিবাদে উঠে দাঁড়ান আবদুল জব্বার খান, যিনি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেন।



‘মুখ ও মুখোশ’ সিনেমাটি পরিচালনা করেন আবদুল জব্বার খান, যিনি এই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও রচনা করেন। তিনি তার নিজের লেখা নাটক ‘ডাকাত’ অবলম্বনে এই সিনেমার গল্প তৈরি করেন। এটি ছিল একটি সামাজিক নাট্যধর্মী গল্প, যা তৎকালীন সমাজের নৈতিকতা, পরিবার এবং সম্পর্কের বিষয়গুলো তুলে ধরে।
নির্মাণ প্রক্রিয়া ছিল অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। আবদুল জব্বার খানের আগে চলচ্চিত্র নির্মাণের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, যেমন স্টুডিও, ক্যামেরা বা প্রশিক্ষিত কলাকুশলী, প্রায় ছিল না। তিনি কলকাতা থেকে ৫,০০০ টাকায় একটি পুরনো ‘আইমো’ ক্যামেরা ক্রয় করেন এবং শব্দ ধারণের জন্য একটি সাধারণ ফিলিপস টেপ রেকর্ডার ব্যবহার করেন। অভিনেতা-অভিনেত্রী নির্বাচনেও সীমাবদ্ধতা ছিল। তৎকালীন সময়ে নারীদের অভিনয়ে আগ্রহ কম থাকায় পুরুষরা নারী চরিত্রে অভিনয় করতেন। তবে এই সিনেমায় স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে কাজ করা হয়, যার মধ্যে আবদুল জব্বার খান নিজেও একটি চরিত্রে অভিনয় করেন।
ইকবাল ফিল্মস এই চলচ্চিত্রের অর্থায়ন ও চিত্রায়নে সহায়তা করে। চলচ্চিত্রটির শুটিং হয় ঢাকার বিভিন্ন স্থানে, এবং এটি সম্পূর্ণ করতে প্রায় তিন বছর সময় লাগে।

১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট ঢাকার রূপমহল প্রেক্ষাগৃহে ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তি পায়। এই ঐতিহাসিক প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। এই সিনেমা দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ সৃষ্টি করে এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

‘মুখ ও মুখোশ’ একটি সামাজিক নাট্যধর্মী চলচ্চিত্র, যা তৎকালীন সমাজের পারিবারিক ও নৈতিক মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করে। এটি ছিল মেলোড্রামাটিক ধাঁচের, যা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠে। সিনেমাটির গল্প সরল হলেও দর্শকদের মন জয় করতে সক্ষম হয়। সীমিত প্রযুক্তি এবং সম্পদের মধ্যেও এর চিত্রায়ন এবং অভিনয় ছিল উল্লেখযোগ্য।

‘মুখ ও মুখোশ’ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের ভিত্তি স্থাপন করে। এটি প্রমাণ করে যে স্থানীয় পরিবেশে এবং সীমিত সম্পদের মধ্যেও মানসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব। এই সিনেমার সাফল্য ঢাকায় চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য স্টুডিও এবং প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগকে ত্বরান্বিত করে। ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (এফডিসি), যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
এই সিনেমা স্থানীয় শিল্পী ও কলাকুশলীদের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করে এবং বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরার পথ প্রশস্ত করে। এটি পরবর্তী প্রজন্মের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের, যেমন জহির রায়হান, সুবাস দত্ত এবং তারেক মাসুদের মতো ব্যক্তিত্বদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।

‘মুখ ও মুখোশ’ যদিও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে, তবে এটি প্রযুক্তিগত ও শৈল্পিক দিক থেকে সীমাবদ্ধ ছিল। সীমিত সরঞ্জাম, অভিজ্ঞতার অভাব এবং প্রশিক্ষিত কলাকুশলীর অপ্রতুলতার কারণে এর প্রযোজনা মান তৎকালীন ভারতীয় বা হলিউডের সিনেমার তুলনায় নিম্নমানের ছিল। তবুও, এর সাফল্য বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে কাজ করে।

‘মুখ ও মুখোশ’ শুধু একটি সিনেমা নয়, এটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের জন্মের প্রতীক। আবদুল জব্বার খানের দৃঢ়চিত্ততা এবং সীমিত সম্পদের মধ্যে এমন একটি কাজ সম্পন্ন করার প্রচেষ্টা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সিনেমা বাংলাদেশের মানুষের সৃজনশীলতা এবং সম্ভাবনার প্রতিফলন ঘটায়। আজও ‘মুখ ও মুখোশ’ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে স্মরণীয়। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সৃজনশীলতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে অসাধ্য সাধন করা সম্ভব।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp