রম্য লেখক, আমিনুল হকঃ
সবুজ শ্যামল গ্রামবাংলার অপরূপ দৃশ্য কার না মন কেড়ে নেয়! চারদিকে সারি সারি গাছ, লতা-পাতা, পাখ-পাখালির ওড়াউড়ি, নদী-নালা, বিল-ঝিল, হাওর-বাঁওড় আর ফসলের মাঠ। সব মিলিয়ে বাংলার প্রকৃতি এক অনুপম সৌন্দর্যে ভরপুর। এই প্রাকৃতিক রূপকে আরও মনোমুগ্ধকর করে তোলে বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা।
গ্রামের তালগাছ বা খেজুরগাছে ঝুলে থাকা বাবুই পাখির বাসাগুলো দেখতে কতই না সুন্দর! বাতাসে দোল খাওয়া এসব বাসা যেন প্রকৃতির নিজস্ব অলংকার। সেই কারণেই বাবুই পাখিকে বলা হয় প্রকৃতির প্রকৌশলী। নিজের ঠোঁটের কারুকার্যে সে গড়ে তোলে এক শিল্পকর্মের নিদর্শন।
একসময় গ্রাম-গঞ্জে, এমনকি শহর-উপশহরেও, বাবুই পাখির বাসা চোখে পড়ত প্রায় সর্বত্র। ছোট্ট এই পাখিটি যখন ঘাসের কঞ্চি, তৃণ ও তন্তু দিয়ে বাসা গাঁথত, তখন মুগ্ধ না হয়ে পারা যেত না।
এই বাসা দেখেই হয়তো চড়ুই পাখির মনে হতো হালকা ঈর্ষা। তার তো এমন দক্ষতা নেই! তাই কবি রজনীকান্ত সেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘স্বাধীনতার সুখ’-এ লিখেছিলেন—
“বাবুই পাখীরে ডাকি’ বলিছে চড়াই,
কুড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই?
আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা’ পরে,
তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে।
বাবুই হাসিয়া কহে—সন্দেহ কি তায়!
কষ্ট পাই, তবুও থাকি নিজের বাসায়;
পাকা হোক, তবুও ভাই পরেরও বাসা,
নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা।”
কবির এ পঙক্তিতে যেমন স্বাধীনতার মহিমা ফুটে উঠেছে, তেমনি ফুটে উঠেছে বাবুই পাখির পরিশ্রম, আত্মনির্ভরতা ও শিল্পচেতনা।
তবে দুঃখের বিষয়, আজ সেই বাবুই পাখি ও তার নিপুণ বাসা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রাম থেকে তালগাছ ও খেজুরগাছ কমে যাওয়া, নিরাপদ আবাসস্থল নষ্ট হওয়া এবং পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা—সব মিলিয়ে এই পাখির অস্তিত্ব হুমকির মুখে।
যদি এ ধারাবাহিকতা চলতে থাকে, তাহলে একদিন প্রকৃতি হারাবে তার এই জীবন্ত শিল্পীকে। বিলীন হয়ে যাবে বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা—যা একসময় বাংলার প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রতীক ছিল। আর সেই সঙ্গে নিঃশেষ হবে আমাদের গ্রামীণ জীবনের এক টুকরো রূপকথা, এক টুকরো আনন্দ, এক টুকরো প্রকৃতি।


