
বাংলাদেশের নগর-গ্রাম সর্বত্রই বাড়ছে কিশোর অপরাধ। বয়সের তুলনায় অপরাধ প্রবণতায় তারা হয়ে উঠছে অস্বাভাবিকভাবে পরিণত। কখনো মাদক ব্যবসায়, কখনো ছিনতাইয়ে, আবার কখনো সংঘবদ্ধ গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ছে এরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রেকর্ড বলছে, সাম্প্রতিক কয়েক বছরে কিশোর অপরাধের হার বেড়েছে কয়েকগুণ। মনে প্রশ্ন জাগে—কিশোররা কেন এমন হয়ে উঠছে? কোথায় এর মূল কারণ?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম বড় কারণ পরিবার। বাবা-মায়ের মধ্যে দূরত্ব, ডিভোর্স, পারিবারিক কলহ বা সন্তানের প্রতি অবহেলা—সব মিলেই তৈরি করছে অস্থির পরিবেশ। সন্তানের মানসিক বিকাশে যেখানে দরকার ভালোবাসা, নিরাপত্তা ও সঠিক দিকনির্দেশনা, সেখানে তারা পাচ্ছে উদাসীনতা আর একাকিত্ব। ফলে কিশোররা সহজেই বিপথে চলে যাচ্ছে।
মোবাইল ফোন, সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন গেম একদিকে যেমন শিশু-কিশোরদের আনন্দ দিচ্ছে, অন্যদিকে বিপজ্জনকভাবে টেনে নিচ্ছে অপরাধ ও আসক্তির দিকে। টিকটক, ফেসবুক বা ইউটিউবের ‘ভিউ’ বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় অনেকে করছে অদ্ভুত সব স্টান্ট, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ কিংবা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। আবার অনেক কিশোর অনলাইনে গড়ে তুলছে গ্যাং—যার পরিণতি ঘটছে রাস্তায় সংঘর্ষ ও সহিংসতায়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুধু বইয়ের জ্ঞান দিলেই যথেষ্ট নয়। নৈতিক শিক্ষা, শৃঙ্খলা ও মানবিকতার পাঠ না থাকলে প্রজন্ম হয়ে ওঠে মূল্যবোধহীন। বর্তমানে স্কুল-কলেজগুলোতে সৃজনশীল কর্মকাণ্ড বা ক্রীড়া-সংস্কৃতির চর্চা কমে গেছে। ফলে কিশোররা নিজেদের প্রকাশের ক্ষেত্র খুঁজে পাচ্ছে না, আর সেখানেই ঢুকে পড়ছে অপরাধের অন্ধকারে।
কিশোর অপরাধ নিয়ে সচেতনতা তৈরির কার্যকর পদক্ষেপ এখনো যথেষ্ট দৃশ্যমান নয়। শহরের অলিগলি থেকে শুরু করে গ্রামের প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে গ্যাং কালচার, কিন্তু অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এটিকে কেবল তাৎক্ষণিক দমনেই সীমাবদ্ধ রাখছে। দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন পরিকল্পনার অভাবে এসব কিশোর আবারও ফিরে যাচ্ছে অপরাধে।
🔹 পরিবারকে সচেতন হতে হবে প্রথমেই—সন্তানের সঙ্গে সময় কাটানো, তাদের কথা শোনা ও মানসিক সমর্থন দেওয়া সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ।
🔹 শিক্ষায় নৈতিকতার চর্চা জরুরি—স্কুল-কলেজে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি জীবনমুখী শিক্ষা, খেলাধুলা ও সংস্কৃতি চর্চা থাকতে হবে।
🔹 প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার শেখানো—শিশু-কিশোরদের অনলাইনে কী করছে, তা অভিভাবকের নজরদারিতে রাখা জরুরি।
🔹 রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ—কিশোর অপরাধীদের জন্য পুনর্বাসন কর্মসূচি ও কাউন্সেলিং সেন্টার চালু করা দরকার, যাতে তারা অপরাধ থেকে ফিরে আসতে পারে।
কিশোর অপরাধ কোনো একটি ব্যক্তির ব্যর্থতা নয়, বরং এটি পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সমষ্টিগত দুর্বলতা। যদি পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ এবং রাষ্ট্র একসঙ্গে এগিয়ে আসে, তবে কিশোরদের অপরাধের অন্ধকার থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আজকের কিশোররাই আগামী দিনের রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি—তাদের হাতে বই, খেলাধুলা ও স্বপ্ন তুলে দিতে পারলে বাংলাদেশ পাবে একটি সুস্থ, মানবিক ও আলোকিত প্রজন্ম।