বিশ্ব প্রযুক্তির ইতিহাসে এক নজিরবিহীন বিপর্যয় দেখা গেল গত ১৮ নভেম্বর। বিশ্বের জনপ্রিয় ইুকমার্স প্ল্যাটফর্ম, ডিসকর্ডসহ প্রায় ২০ শতাংশ শীর্ষ ওয়েবসাইট হঠাৎ করেই অচল হয়ে পড়ে। ব্রাউজারজুড়ে ভেসে ওঠে ‘500 Internal Server Error’ বা ‘502 Bad Gateway’। অনেকে ভেবেছিলেন এটি হয়তো তাদের মোবাইল ডেটা বা ওয়াইুফাই সমস্যা, কিন্তু বাস্তবে ঘটছিল বৈশ্বিক ডিজিটাল স্থবিরতা।
এই বিপর্যয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বিশ্বের বৃহত্তম ওয়েব নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ক্লাউডফ্লেয়ার—যা ইন্টারনেটের ট্রাফিক পুলিশ হিসেবে পরিচিত।
একটি ভুল কনফিগারেশনেই বিশ্বব্যাপী অচল
ক্লাউডফ্লেয়ারের সিইও ম্যাথিউ প্রিন্সের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এটি হ্যাকারদের আক্রমণ বা সাইবার যুদ্ধ নয়—বরং একটি অভ্যন্তরীণ যান্ত্রিক ত্রুটি।
ক্লাউডফ্লেয়ার তাদের ওয়েব নিরাপত্তায় ব্যবহার করে বট ম্যানেজমেন্ট” নামের একটি সিস্টেম।
১৮ নভেম্বর বিকেলে ইঞ্জিনিয়াররা সিস্টেমটিতে একটি ‘কনফিগারেশন আপডেট’ দেন।
ভুলবশত সেই ফাইলের সাইজ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়।
ফাইলটি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সার্ভারে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে সার্ভারের প্রসেসর তা লোড করতে ব্যর্থ হয়।
মুহূর্তেই ক্র্যাশ করে সার্ভার—বন্ধ হয়ে যায় হাজারো ওয়েবসাইট।
প্রায় ৫ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর রাত ৯টার দিকে ক্লাউডফ্লেয়ার পুরনো কনফিগারেশনে ফিরে গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। ঘটনাটি দেখিয়ে দিয়েছে, আধুনিক ইন্টারনেট ব্যবস্থায় এখনো আছে সিঙ্গেল পয়েন্ট অফ ফেইলিউরুএর ভয়াবহ ঝুঁকি।
ক্লাউডফ্লেয়ারের বিকল্প কারা?
এ ঘটনার পর বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন—বিশ্ব কি অত্যাধিক ক্লাউডফ্লেয়ারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে?
শক্তিশালী বিকল্পগুলো হলো—
আকামাই: সবচেয়ে পুরনো ও নির্ভরযোগ্য ঈউঘ।
ফাস্টলি: রিয়েলুটাইম ডেটা প্রসেসিংয়ে দ্রুত, তবে ২০২১ সালে তাদেরও বড় বিপর্যয় হয়েছিল।
অ্যামাজন ক্লাউডফ্রন্ট: বিশ্বের বৃহত্তম কন্টেন্ট ডেলিভারি নেটওয়ার্কগুলোর একটি।
গুগল ক্লাউড ঈউঘ: গুগলের ইনফ্রাস্ট্রাকচারুনির্ভর দ্রুত বর্ধনশীল সেবা।
মহাসমুদ্র পেরিয়ে বাংলাদেশে ইন্টারনেটের যাত্রা
অনেকেই মনে করেন ইন্টারনেট আসে স্যাটেলাইট দিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশের ৯৫% ইন্টারনেটই আসে সমুদ্রের নিচে বিছানো অপটিক্যাল ফাইবার—সাবমেরিন ক্যাবল দিয়ে।
বাংলাদেশ যে সাবমেরিন ক্যাবলের সঙ্গে যুক্ত
সিুমিুউই ৪ — কক্সবাজার
সিুমিুউই ৫ — কুয়াকাটা (ব্যান্ডউইথের বড় জোগানদাতা)
সিুমিুউই ৬ — ২০২৬ সালে চালু হবে (ক্ষমতা বাড়াবে বহুগুণ)
বিকল্প পথ: আইটিসি
সাবমেরিন ক্যাবল ক্ষতিগ্রস্ত হলে ব্যাকআপ আসে ভারত থেকে মাটির নিচে ফাইবার ক্যাবল হয়ে—
সামিট কমিউনিকেশনস, ফাইবার অ্যাট হোম ইত্যাদি টাটাুএয়ারটেলের নেটওয়ার্ক দিয়ে সংযোগ চালু রাখে।
দেশে ইন্টারনেট পৌঁছে যাওয়ার ধাপুধাপ প্রক্রিয়া
ধাপ ১ — এনটিটিএন: দেশের ভেতরের মহাসড়ক
সমুদ্র থেকে আসা ব্যান্ডউইথ সারা দেশে ছড়িয়ে দেয় ঝঁসসরঃ, ঋরনবৎ@ঐড়সবুএর মতো এনটিটিএন নেটওয়ার্ক।
ধাপ ২ — আইআইজি: পাইকারি বিক্রেতা
ঢাকায় এসে ব্যান্ডউইথ যায় ওওএ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে—
যেমন: বিটিসিএল, ম্যাঙ্গো।
ধাপ ৩ — আইএসপি: আপনার এলাকার প্রোভাইডার
তারা ব্যান্ডউইথ কিনে রাস্তার তারের মাধ্যমে আপনার বাসায় পৌঁছে দেয়।
গ্রাহকের হাতে ইন্টারনেট পৌঁছানোর শেষ ধাপ
ব্রডব্যান্ড
ফাইবার → ওনু → রাউটার → আপনার ফোন/ল্যাপটপ।
মোবাইল ইন্টারনেট
১) ফোনের সিগন্যাল যায় নিকটস্থ টাওয়ারে
২) টাওয়ার থেকে ফাইবার ক্যাবল দিয়ে অপারেটরের সার্ভারে
৩) সার্ভার → আইআইজি → সাবমেরিন ক্যাবল → বিশ্বের সার্ভার (যেমন ইউটিউব)
৪) একই পথে ফিরে এসে ফোনে পৌঁছে যায়
এই যাত্রাটি ঘটে মাত্র মিলিসেকেন্ডে।
বিপর্যয় দেখিয়ে দিল—ইন্টারনেট অবকাঠামো এখন জাতীয় নিরাপত্তার অংশ
ক্লাউডফ্লেয়ারের বিপর্যয় ও বাংলাদেশের ইন্টারনেট কাঠামোর বাস্তবতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—ইন্টারনেট এখন অর্থনীতির প্রাণশক্তি।
সমুদ্রের গভীর, মাটির নিচের ফাইবার ও বাতাসের তরঙ্গ—এই অদৃশ্য জাল সচল রাখতে প্রতিদিন নিরলস কাজ করছেন হাজারো প্রকৌশলী।
একটি গ্লোবাল সিস্টেমে একটিমাত্র ভুলও পৃথিবীর বড় অংশকে থামিয়ে দিতে পারে—এটি তার স্পষ্ট উদাহরণ।


