বিলসুতি বিলকে বাঁচাবে কে!

বিলের নাম বিলসুতি, বিলে গেলেই আধা পেটি! অথবা মাছ ধরিলে কৈই মাগুর-ভাতার ধরিলে সভার ঠাকুর। বিলসুতি বিলকে কেন্দ্র করে এমন গপ্প শুনতাম আব্বাদের কাছ থেকে। বলছি রাজশাহী জেলার বাগমারা উপজেলার বিলসূতি বিলের কথা। একসময় পদ্মর মুলাম, পদ্মফুল-ফল, শাপলা, ভ্যাট (শাপলা ফল) আর প্রচুর মাছে ভরপুর ছিল আমাদের বিলসুতি। একারনেই বলা হতো বিলে গেলেই আধা পেটি (আধা পেট)।

বলছি রাজশাহী জেলার বাগমারা উপজেলার বিলসুতি বিলের কথা। এ বিলকে কেন্দ্র করে বেশকিছু দাড়া (উপনদী) ছিল। ৯০ এর দশকেও এই বিলে প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় ছিল। শ্যালো মেশিন বা গভীর নলকূপের প্রচলন তখনও শুরু হয়নি, জাত (পানি সেঁচের জন্য কাঠ দিয়ে তৈরী এক ধরনের দেশী প্রযুক্তি) দিয়ে বুরো জমিতে পানি সেচ দেওয়া হতো।

চৈত্র মাসে, খরার সময় আত্রাই নদীতে জুতবাজার এলাকায় বাঁধ দিয়ে বিলে পানি নিয়ে আসা হতো। প্রতি বছর চৈত্রমাসে আব্বারা যেত বাঁধ দিতে, কয়েকদিন থাকতে হবে এজন্য অনেকগুলো রুটি বেঁধে নিয়ে যেত। অনেকে বাঁধ দেওয়ার সময় স্রোতে ভেসে যেত,ফি বছর মারা যেত কেউ না কেউ। চৈত্র বৈশাখ মাসে বিলের পানি শুকানোর আগে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। কৈ, শোল,চিংড়ি, গজাড়, বোয়াল, কালবাউস, রুই, কাতলা মাগুর, কানচ (শিং), পুঁটি, খলশ্যা, নোন্যা ( ভ্যাদা বা রইনা) আরো কত কি মাছ! সবই ছিল দেশী প্রকৃতির মাছ। কতশত পাখি বিলে উড়ে বেড়াতো তার হিসাব করা কঠিণ, শীতের সময় আসতো পরিযায়ী পাখির দল! এই বিলকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহের জন্য গড়ে উঠেছিল জেলে জনগোষ্ঠি। সারা রাত মাছ ধরে নিয়ে যেত হাট বাজারে। বর্তমানে তাঁদের ভাত মেরেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দখলদাররা। এই কিছুদিন আগে জেলেরা আন্দোলনে নেমেছিল জলমহল উন্মক্ত করার দাবিতে। রাজনৈতিক দলের দখলদারা তাঁদের বৃদ্ধাগুলি দেখিয়ে এখনও দখলে রেখেছে বিলসুতির জলমহল।

এই বিলকে কেন্দ্র করে অনেকগুলো দাড়া(উপনদী) ছিল ঠিক জালের মতো বিছিয়ে। এগুলোর একটি বারনই নদী, এই নদী হতে উৎপত্তি লাভ করে ঢেকরতলা হয়ে বিলসুতি বিলে পড়ে, মরাঘাটি এসে দুটি ভাগ হয়ে কোয়াল পাড়া হয়ে আবার বারনই নদীতে গিয়ে পড়ে (বারনই নদীকে এলাকার মানুষজন ফকিন্নি নদী বলে)। মীরপুরের ভিরত দিয়ে আসে আরেক অংশ, দ্বীপচাঁদপুরের ভিতর দিয়ে আরেক অংশ আসে। যথাক্রমে একটি এসে পড়ে পাহাড়পুর নামক গ্রামে অন্যটি বড়শিমলা  নামক এলাকায়। এই বিলের সমস্ত পানি নামতো দুটি দাড়া (উপনদী) দিয়ে , সবচেয়ে বেশি পানি নামতো গজমতখালি দাড়ি(উপনদী) দিয়ে। অপর অংশ চলে যেত একডালার ভেতর দিয়ে বারনই নদীতে। বড় বিহানালীর ভেতর দিয়ে ঝাড়গ্রাম বিল হয়ে কিছু পানি নামতো।

বড় বিহানালী ইউনিয়ন ছিল মূলত ভাটি এলাকা, একারণে এই ইউনিয়নে বেশকিছু দাড়ি ছিল। প্রায় প্রত্যেক গ্রামের ভিতর দিয়েই ছিল। নিমতলি ব্রিজ হয়ে বড়কয়া মরাঘাটি হয়ে বিলসুতি বিলে পড়ে একটি অংশ। আরেক অংশ খালিশপুর, কাজিপাড়া হয়ে কোচুয়া বিলে পড়ে। এর আরেকটি অংশ বিহানালী হাইস্কুলের পেছন দিয়ে বিহানালীর ভেতর দিয়ে ঝাড়গ্রাম বিলে পড়ে। ঝাড়গ্রামের দাড়িটি মূলত কহিতপাড়া হয়ে গাঙ্গোপাড়া হয়ে বৈলসিংহ দিয়ে আবার বারনই নদীতে যুক্তছিল। আরেকটি ছিল মুরারীপাড়া, চকপাড়ার ভিতর দিয়ে হাগাকুড়ি ব্রিজ হয়ে একটা চলে যায় বিহানালীর দিকে অন্যটি রাস্তা ঘেসে আমবাড়িয়ার দিকে। ডালানতলা হতে কুলিবাড়ি বিল হয়ে কাহিতপাড়া,বৈলসিংহ যুক্ত ছিল আরেকটা দাড়ি। এভাবে পুরো এলাকা জালের মতো বিছিয়ে ছিল নদী, খাল, দাড়া, দাড়ি ইদ্যাদি। ফলে বর্ষাকালে পানির অবাধ প্রবাহ ছিল, বৃষ্টির পানি জমলে সেখানে মাছের আনাগোনা দেখা যেত।

স্থানীয় জনগনের অজ্ঞতা,দলীয় প্রভাবশালীদের দখলদারিত্ব,আর সরকারি জলমহল খেকোদের কবলে পড়ে আজ সবই বিলুপ্ত হয়েছে। অবাক করা দুটি বিষয় হচ্ছে, বড় বিহানালী উচ্চ বিদ্যালয় শত বছরের একটি পুকুর ভরাট করে স্কুল প্রসস্ত করেছে। আবার ঔ স্কুলের তিনপাশে যে ক্লাশরুম ছিল সেগুলো বন্ধ করে,দোকান ঘর নির্মাণ করে ব্যবসায়ীদের কাছে ভাড়া দিয়েছে!এটা এখন বিদ্যার আলয় নাকি ব্যবসার আলয় সেটা বোঝা মুশকিলই বটে। আরেকটা হচ্ছে বড় বিহানালী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড কলেজ । ঔ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠার পর প্রথম তারাই মাঝখানের দাড়া বন্ধ করে দেয়। ঔখানে যে কোনকালে দাড়া ছিল এটা আর বোঝার উপায় নেই। এই দুই প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করার বিশেষ কারণ আছে। বিদ্যালয় মানে হচ্ছে বিদ্যার আলয়, যেখানে সমস্ত পৃথিবীর জ্ঞানের চাষ-বাস করবার কথা। প্রাণ-প্রকৃতি, পরিবেশ-পতিবেশ, সাম্য-ন্যায়, ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করবার কথা সেই প্রতিষ্ঠানগুলো কিনা প্রান-প্রকৃতি ধ্বংস করে। জানিনা এখানকার শিক্ষকরা বিষয়টা কিভাবে দেখেন। তবে যেভাবেই দেখুন এখানকার শিক্ষার্থীরা যে প্রকৃতি প্রেমী হবে না সে কথা জোর দিয়েই বলা যায়। আরেকটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার ফটকাবাজারি পুঁজির কবলে পড়েছে আমাদের বিলসুতি।  বানিজ্যিকভাবে মাছ চাষের নামে অবাধে পুকুর, দিঘী খনন দখলবাজরা। এখানেও প্রভাব বিস্তার করে আছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাচা টাকাওয়ালারা। পুরো বিলসুতি এখন তাদের দখলে।

আমার ছোট বেলার সেই বিলসুতি আর আমার নেই,এখন আর শাপলা ফুল ফোটে না,পানকৌড়ি ডাকে না। নানা জাতের পরিযায়ী পাখিরা আর আসে না,চৈত্রের বিকেলে আর ঘুটা কুড়ানিদের দেখা যায় না, পদ্মর মোলাম পাওয়া যায় না, পদ্ম পাতায় গুড় আর নুন আনা হয় না বাজার থেকে। এখন বিলসুতি বিলে আছে শতশত বানিজ্যিক পুকুর আর দিঘী ,এখানে এখন চাষ হয় দুই, চার, পাঁচ কেজি ওজনের মাছ। সেটা এলাকার মানুষজন চোখে দেখি কিন্তু একটি মাছও স্থানীয় বাজারে বিক্রি হয় না!

 আমাদের পুষ্টিহীন রেখে মাছগুলো চলে যায় বড় বড় শহরে যেখানে থাকে পুঁজির পাহাদাররা।একদিকে এই দখলদাররা অন্যদিকে আমাদের অবুঝ কৃষকেরা ঔষুধ কোম্পানীর চাটুকদার বিজ্ঞাপণে প্রলুব্ধ হয়ে ফসলে নানা ধরনের বিষ প্রয়োগ করে  যেমন দেশী মাছের ডিম নষ্ট করছে,অপরদিকে বিল খেকোরা প্রতিবছর বিষ দিয়ে মাছ নিধন করে দেশী মাছের বিনাশ সাধন করছে। একারণে ভরা মৌসুমে বিলের দেশী মাছ পাওয়া দুষ্কর হয়ে গেছে। এভাবেই একটি জীবন্ত বিলকে হত্যা করা হয়েছে। এখন আর বিলে গেলে আধা পেট ভরে না। বিলসুতিকে রক্ষা করতে হলে গ্রাম-বাংলার মেহনতি মানুষদের এক হয়ে গন আন্দোলন গড়ে তোলার বিকল্প নেই।এগিয়ে আসতে হবে তরুন প্রজন্মকে।মনে রাখতে হবে এই বিল শুধু কৃষক,শ্রমিক,জেলেদের নয়। এই বিল প্রকৃতির ভারসাম্য , পরিবেশ-পতিবেশ রক্ষাকারী বিল। এই বিল রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সকলের। সকলের অংশগ্রহনই পারে আমাদের এই বিলসুতি বিলকে রক্ষা করতে।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp